এক যুগের বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাতে বহু হামলা-ষড়যন্ত্র করেছে। এখনো তাদের হামলা অব্যাহত। আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সহায়তা দেয়া ছাড়াও সিরিয়ার ওপর সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মধ্যপ্রাচ্যর পরাশক্তি ইরান। আসাদের বিপদের পুরোটা সময় তার পাশে থেকেছে তেহরান। এমনকি বিদ্রোহীদের কাছে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারে আসাদ বাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে ইরান। তবে এই দুই বন্ধু দেশের মধ্যে এখন বিরোধ সৃষ্টি করতে নতুন ফন্দি আঁটছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে ইরানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অবসান চায় যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ নিয়ে সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছে দেশ দুটি।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা
সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই গৃহযুদ্ধ এখনো অবসান হয়নি। তবে কয়েক বছর আগেই দেশটির অধিকাংশ অঞ্চলে সংঘর্ষ থেমে গিয়েছিল। মিত্র ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় আসাদ বাহিনী সিরিয়ার বেশির ভাগ অংশ এবং সব বড় বড় নগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ২০১৬ সাল থেকে আলেপ্পো সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর দখলেই ছিল।
তবে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, গত বুধবার সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী আলেপ্পো দখল করেছে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর পাশাপাশি সেখানকার বিমানবন্দর ও আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও আলেপ্পোর অধিকাংশ এলাকায় বিদ্রোহীদের প্রবেশের কথা স্বীকার করা হয়েছে।
গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদকে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। আসাদের পক্ষে তার মিত্র রাশিয়া বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। আকস্মিক বিদ্রোহীদের হাতে আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নতুন মোড় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
২০১১ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমন করলে সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তী বছরগুলোয় এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করে মার্কিন সরকার। এদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞাটি সিজার অ্যাক্ট নামে পরিচিত। এটি ২০১৯ সালে মার্কিন কংগ্রেসে পাস হয়।
সিজার নিষেধাজ্ঞায় সিরিয়ার ব্যবসা খাতকে টার্গেট করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত যে কারও ওপর প্রযোজ্য হবে, তা যে দেশের নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান হোক না কেন। এমনকি সিরিয়ায় অবস্থিত রাশিয়া ও ইরানের সংস্থার সঙ্গে লেনদেনকারী যে কারোর ওপরও এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য।
প্রেসিডেন্ট আসাদ এসব মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে অর্থনৈতিক যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, সিরিয়ার মুদ্রার পতন ও জীবনমানের নিম্নগতির জন্য এসব নিষেধাজ্ঞা দায়ী। তবে আগামী ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে যদি না মার্কিন আইনপ্রণেতারা সেগুলো নবায়ন করেন।
যুক্তরাষ্ট্র-আমিরাতের মধ্যে কী আলোচনা হলো
বাশার আল-আসাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এর বিনিময়ে তারা চায়, ইরানের প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন আসাদ। একই সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের রুট বন্ধ করে দেবেন। পাঁচজন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বরাতে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
তারা জানান, সাম্প্রতিক মাসে এই আলোচনা আরও জোরদার হয়েছে। বিশেষত ২০ ডিসেম্বর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রক্সি নেটওয়ার্কের ওপর ইসরায়েলের অনবরত হামলার কারণে এই আলোচনায় গতি এসেছে।
ইসরায়েল সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বলে লেবাননের গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এখনো আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগ সম্পর্কে কেউ কোনো প্রতিবেদন করেনি। এ বিষয়ে সিরিয়ার সরকার ও হোয়াইট হাউস রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দেয়নি। আমিরাতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও আসাদের মধ্যকার ফোনকল নিয়ে তাদের বিবৃতি দেখার পরামর্শ দিয়েছে।
আসাদকে সতর্ক করে ইরানের বার্তা
তেহরানের বিষয়ে জানাশোনা আছে এমন একজন ঊর্ধ্বতন আঞ্চলিক কূটনীতিক জানান, কিছু আরব দেশ সিরিয়াকে তেহরানের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার প্রস্তাবের বিষয়টি রয়েছে।
তবে ওই কূটনীতিক জানান, ইরান আসাদকে সতর্ক করে দিয়েছে যে তিনি যেন খুব বেশি দূরে সরে না যান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেয়ি তার সিনিয়র উপদেষ্টা আলি লারিজানির মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। সেখানে আসাদকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে,‘অতীত ভুলে যেও না’।