জেরুজালেমে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কট্টরপন্থি ইহুদি এবং ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের যে ছোটখাটো সংঘাত চলছিল সোমবার তা বিপজ্জনক এক লড়াইয়ে রূপ নেয়।
সোমবার জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিন শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাজা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের দিকে রকেট ছোঁড়া শুরু করে।
বিনিময়ে ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরু করে। ফলে ভূখণ্ডটিতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১০ জনেরও বেশি শিশু রয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, গাজা থেকে ছোঁড়া রকেটে দক্ষিণাঞ্চলীয় আশকেলন শহরের দু’টি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ২০ জন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের পরে এই প্রথম গাজা থেকে জেরুজালেমকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে। কয়েকটি রকেট শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়ে – যদিও হতাহতের কোনো খবর নেই।
জেরুজালেমের সাংবাদিক হরিন্দর মিশ্র বলছেন, গত সাত বছরের মধ্যে সোমবার প্রথম জেরুজালেমে ইসরায়েলিদের সতর্ক করতে কয়েকবার সাইরেন বেজেছে। তিনি বলেন, ‘জেরুজালেম শহরের পরিস্থিতি থমথমে। শহরের পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মোড়ে মোড়ে এবং স্পর্শকাতর প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর বাইরে প্রচুর পুলিশ। অনেক বছর পর জেরুজালেমে এরকম টান টান উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে।’
জেরুজালেম লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়ার ঘটনাকে ইসরায়েল খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাস ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করেছে এবং এর শাস্তি তাদের পেতে হবে। এরপরই গাজায় শুরু হয় ইসরায়েলি বোমা হামলা।
ইসরায়েলি বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে, দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচ হাজার রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন দফা এই সংঘাত ও রক্তপাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মধ্যস্থতার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
হঠাৎ এই সংঘাত কেন?
করোনা মহামারির মধ্যে নতুন করে এই লড়াই-সহিংসতা বাঁধলো কেন?
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা জেরেমি বোওয়েন বলছেন, দশকের পর দশক ধরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধর মূলে যেসব কারণ সেগুলোর কোনো সমাধান এতদিনেও হয়নি বলেই ঘুরে ফিরে এই সংঘাত বাঁধে।
পূর্ব জেরুজালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
শেখ জারাহয় যে জমির ওপর ওই চারটি ফিলিস্তিনি পরিবার গত প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাস করছেন, হঠাৎ তার মালিকানা দাবি করে কয়েকজন কট্টরপন্থী ইহুদি। জেরুজালেম নগর কর্তৃপক্ষ এবং শহরের একটি নিম্ন আদালত সেই দাবি মেনেও নেয়। ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভের সূচনা সেখান থেকেই।
বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে যে ইসারায়েলি কট্টরপন্থিরা জেরুজালেম থেকে বিভিন্ন কৌশলে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর এবং শেখ জারাহ থেকে ওই চারটি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার সিদ্ধান্ত সেই ছকেরই অংশ।
শেখ জারাহ এবং জেরুজালেমের পুরনো এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ফিলিস্তিনি কিশোর তরুণদের সাথে লেহাবা এবং আরও কিছু কট্টর ইহুদি সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে হাতাহাতি, গালিগালাজ বিনিময় চলছিল।
এরই মধ্যে রোজার শুরুতে পুলিশ জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। যেমন, বহুদিন ধরেই রোজার সময় পুরনো শহরের দামেস্ক গেটের চত্বরে সন্ধ্যায় জড়ো হয়ে ইফতার করে অনেক ফিলিস্তিনি। এবার ইসরায়েলি পুলিশ তা নিষিদ্ধ করে – যা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়। সেই সঙ্গে যোগ হয় কট্টর ইহুদিদের ‘জেরুজালেম দিবস’ কুচকাওয়াজ নিয়ে উত্তেজনা।
১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম দখলের ঘটনাকে ইসরায়েলি কট্টরপন্থিরা প্রতিবছর উদযাপন করে। প্রতিবছর ১০ মে এই উপলক্ষে কয়েক হাজার ইহুদি পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি এলাকার ভেতরে দিয়ে মিছিল করে।
এবছর ঘটনাক্রমে দিনটি পড়েছে রোজার ভেতর। ফিলিস্তিনিরা চেয়েছিল এবার যেন ওই মিছিলের রুট বদলানো হয়। কিন্তু ইসরায়েলি পুলিশ বা নগর কর্তৃপক্ষ তাতে কান দেয়নি; যা নিয়ে ফিলিস্তিনিরা ক্ষুব্ধ ছিল। তবে সোমবার শেষ মুহূর্তের এক সিদ্ধান্তে মিছিলটি ফিলিস্তিনি এলাকায় যেতে দেওয়া হয়নি।
ইসরায়েলি রাজনীতির যোগসূত্র
সোমবার সকালে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশি অভিযান, তারপর সেই রাতেই ইসরায়েলকে লক্ষ্য গাজা থেকে রকেট ছোঁড়া এবং গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর সংঘাত যে বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে, তা ২০১৮ সালের পর দেখা যায়নি।
সাংবাদিক হরিন্দর মিশ্র বলছেন, কয়েক বছর ধরে শান্তি আলোচনায় পুরোপুরি স্থবিরতা এবং করোনা মহামারির কারণে বহু মানুষ যে অর্থনৈতিক চাপে পড়েছেন সেটিও বহু মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা তৈরি করেছে যেটি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এই সংঘাতর পেছনে কাজ করছে বলে মনে করেন মিশ্র। গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলে একের পর এক নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। গত নির্বাচনের পরও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু শরীক জোগাড় করে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে বিরোধী ইয়েস আডিট দলের নেতা ইয়ার লাপিডকে সরকার গঠনের সুযোগ দেন প্রেসিডেন্ট।
হরিন্দর মিশ্র বলেন, ‘সরকার গড়তে হলে আরব দলগুলোর সমর্থন দরকার লাপিডের। সেই চেষ্টা তিনি করছিলেন। এখন জেরুজালেমের ঘটনাপ্রবাহ, ফিলিস্তিনি পরিবার উচ্ছেদের ঘটনায় আরব দলগুলো তো আর কথা বলতে চাইছে না। সোমবারের পর লাপিড এবং তার বর্তমান শরিকদেরও এখন সরকার ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।’
ফলে, জোট সরকারের গঠনে লাপিডের চেষ্টা ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। সুতরাং, হরিন্দর মিশ্র মনে করেন, চলতি এই সংঘাতের রাজনৈতিক ফায়দা এখন নিশ্চিতভাবেই পাবেন নেতানিয়াহু।
এখন পরিস্থিতির চাপে লাপিড যদি জোট গঠনে ব্যর্থ হন, তাহলে ইসরায়েলে আরেক দফা নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে চলতি এই বিরোধ হয়তো সেই নির্বাচনে নেতানিয়াহুকে সাহায্য করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা