দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত জেলা সিলেট ঘেঁষে মেঘালয়ের আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের নিচে নয়ন জুড়ানো শীতল পানিতে যেন ভাসছে রাশি রাশি ছোট ছোট পাথর। পানি আর পাথরের সেতুবন্ধনই সাদা পাথর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। হেমন্তে সাদা পাথরের ফাঁকে ফাঁকে শীতল পানির স্রোতধারা।
বর্ষায় আকাশ ছোঁয়া মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসে অসংখ্য ঝরনাধারা। আবার মাঝেমধ্যে পাহাড়ের গায়ে তুলোর মতো মেঘরাশির অপরূপ সুন্দর্য্যের দেখা মেলে সীমান্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জে।
সিলেটের এই অঞ্চলটি দেশের ভ্রমন পিপাসু ও বিনোদন প্রেমীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। শীত- গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমেই প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমন পিপাসু নর-নারী, যুবা-বৃদ্ধ প্রাকৃতিক সুন্দর্য্যে উপভোগ করতে ছুটে আসেন এই সাদা পাথর দেখতে। এই সাদা পাথর না দেখলে ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়,এমনটাই মনে করেন এখানে বেড়াতে আসা প্রকৃতিপ্রেমীরা।
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা স্ফটিক স্বচ্ছ জলের নিচে নানা রঙের পাথরের খেলা চলে অবিরত। গরমে হিমশীতল জলে গা ভিজিয়ে ঝিরি ঝিরি স্রোতে আপন মনে ভেসে চলা এক পরম সুখকর অনুভূতি। কেউবা হামাগুড়ি দিয়ে সাঁতার কাটে। আবার কেউ টিউবের ওপর ভেসে বেড়ায় স্রোতের টানে।
অনেককাল আগ থেকেই পাহাড়, পানি, পাথর, ঝরনা মিলিয়ে প্রকৃতির এই রূপকথার রাজ্যে ছুটে আসতেন। তখন জায়গাটি অনেকটাই দুর্গম ছিল। কয়েক বছরে সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কটি উন্নত হওয়ায় এখন সাদা পাথর এলাকাটি নতুন রূপে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মূলত এটি অপূর্ব এক পাথুরে রাজ্য।
এখানে এক সময় ছাতক-ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে লাইন নির্মিত হয়। রেললাইনের স্লিপারের নিচে পাথর সরবরাহের জন্য ভোলাগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় পাথর ধ্বংসকারী মেশিন স্থাপন করা হয়। নানা কারণে সেটি বিনষ্ট হয়ে গেলেও অবকাঠামো বিদ্যমান রয়েছে।
সিলেট থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে সড়ক পথে যাওয়া যায় ভোলাগঞ্জ সাদা পাথরে এলাকায়। তবে সেখানকার ধূলিময় ১০ নম্বর নৌকা ঘাট এলাকা প্রথমে বিরক্তির সৃষ্টি করে। কারণ ঐ স্থানে রয়েছে পাথর ভাঙার অসংখ্য ক্রাশার মেশিন। তাছাড়া ঐ স্থানে রয়েছে ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশন। এই পথে ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানি হয়।
প্রতিদিন এখানে অন্তত ৩০ সহস্রাধিক লোকের আনাগোনা। ১০ নম্বর ঘাট থেকে নৌকা করে ২০ মিনিটের দূরত্বে যেতে হয় সাদা পাথর স্পটে। ৮ জনের নৌকা ৮০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে যাওয়া যায়। সীমান্ত এলাকায় রয়েছে ভোলাগঞ্জ বিজিবি ক্যাম্প ও একটি মসজিদ।
কথা হয় চট্টগ্রাম থেকে সাদা পাথর দেখতে আসা শিক্ষানুরাগী আবদুল মতিন সেলিম, সেলিমুজ্জামান, আনোয়ার সিদ্দিক চৌধুরী এবং ব্যবসায়ী কায়সার আহমদ ও জাহাঙ্গীর সিদ্দিক চৌধুরীর সঙ্গে। তাদের ভাষায়, সাদা পাথর এলাকা আমাদের মুগ্ধ করেছে। তবে এখানের পরিবেশ আরও শৃঙ্খলিত ও পরিকল্পিত করলে উপভোগ্য হবে; পর্যটক বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রসার লাভ করবে।
গত বছর কয়েক দফা বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ভারত থেকে প্রচুর সাদা পাথর নতুন রূপে সাজিয়েছে ভোলাগঞ্জকে। এক সময় এখান থেকে প্রচুর বালি ও বোল্ডার পাথর তোলা হতো পরিবেশ বিধ্বংসী বোমা মেশিন দিয়ে। এখন বোমা মেশিন বন্ধ থাকায় সেখানকার দৃশ্যপটে এসেছে সজীবতা।
নদীতে শুধু পর্যটকবাহী নৌকার মেলা। আর মাঝে মধ্যে সনাতন পদ্ধতিতে নর-নারীর পাথর তোলার দৃশ্য। সিলেটের ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান মাসুম বলেন, অচিরেই সিলেট হবে দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণ। তবে এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন আচার্য্য বলেন, অচিরেই ১০ নম্বর ঘাটে পর্যটকদের থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় সুবিধার লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এর ডিজাইন করা হচ্ছে।
সিলেট হোটেল এন্ড গেস্ট হাউজ ওনার্স এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খন্দকার শিপার আহমদ বলেন, সিলেটে দিনে দিনে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে পর্যটন স্পটগুলোর প্রতি আরও যত্ন নেওয়া দরকার। আর তা হলে বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে।