গত ফেব্রুয়ারিতে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থামানোর লক্ষ্যে বেশির ভাগ উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় চীন। ওই সময় দেশটির পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয় এবং অনেক মানুষকে নিজেদের ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হয়। কর্মীদের বলা হয় নিরাপদে কারখানা খোলার পরিকল্পনা কার্যকর করার আগ পর্যন্ত জনবহুল জায়গাগুলো এড়িয়ে চলতে। তবে এর মাঝেও চীনের বৃহত্তর শহরের উপকণ্ঠে টেসলা নিজেদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল। উৎপাদনের কার্যক্রমে হাজারো শ্রমিককে বহাল রাখা হয়। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে তাদের অনেককেই কর্মস্থলে আসার জন্য সরকারি বাস সুবিধা প্রদান করা হয়। এমনকি অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যেখানে এন৯৫ মাস্কের স্বল্পতায় ভুগছিল, সেখানে টেসলার কর্মীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ মাস্ক বরাদ্দ ছিল। এছাড়া কারখানা জীবাণুমুক্ত করার জন্য যে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রক লাইসেন্সও তাদের হাতে ছিল।
এদিকে উৎপাদন কাজ পুনরায় শুরুর পর এখনো টয়োটা মোটর গ্রুপ, ফক্সওয়াগন এবং অন্যান্য বিদেশী গাড়ি প্রস্তুতকারক যেখানে নিজেদের কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে শুরু করতে পারেনি, টেসলা সাংহাই সেখানে ১ হাজার গাড়ি তৈরি করেছে। মার্চের মধ্যে সেটি সপ্তাহে তিন হাজারে গিয়ে পৌঁছবে, যা কিনা শাটডাউনের আগের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
টেসলার উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য টেসলা সরকারের কাছ কেবল অনুমতিই পায়নি, বরং তারা পুলিশি প্রহরাও পাচ্ছে।
২০১৮ সালে সাংহাইয়ে প্লান্টের পরিকল্পনা ঘোষণার পর থেকে টেসলা মূলত চীন সরকারের এমন বদান্যতা পেয়ে আসছে। এই মহামারীকালেও উৎপাদন কার্যক্রম দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরায় ভূমিকা রেখেছে দুই পক্ষের এই উষ্ণ সম্পর্ক। সরকারি এই সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে টেসলার সবচেয়ে বড় বাজারও হয়ে ওঠে চীন। মডেল ১৩ এখন চীনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া গাড়িগুলোর তালিকায় ওপরের দিকে উঠে এসেছে। টেসলার সাম্প্রতিক আয় প্রতিবেদন বলছে, চীন তাদের এক-পঞ্চমাংশ আয়ের উৎস। পাশাপাশি চীনে টেসলার এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ইলোন মাস্ককে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় শীর্ষে উঠতেও সাহায্য করেছে। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটি তা হলো, টেসলা অন্য যেকোনো বিদেশী প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় ক্ষ্যাপাটে চীনা প্রযুক্তি খাতের সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছে। চীনে টেসলা এখন সাধারণ একটি শাখা কারখানার চেয়েও বেশি কিছু। এখানে তাদের উদ্দেশ্য মৌলিক গবেষণা এবং বিকাশের লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিবেশও তৈরি করা, যা দেশটির প্রতিভাবান প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানোর এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের দূরে রাখারও সুযোগ করে দিয়েছে।
বিপরীতে টেসলা এবং তাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চীন সম্পর্কিত সব কাজ এখন পর্যন্ত ঠিকঠাক সম্পন্ন করেছে। ইলোন মাস্ক এখন চীনের মেধাবীদের এবং এর বৈদ্যুতিক গাড়ির উচ্চাবিলাসী পরিকল্পনাকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিচ্ছেন। চীনের সঙ্গে ঠিকঠাকভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারা টেসলার জন্য দারুণ এক সাফল্য বটে, যেখানে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সংবেদনশীল। পাশাপাশি টেসলার স্থানীয় ইউনিটও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে নিজেদের সুস্পষ্টভাবে একত্র করেছে। ফলে চীনের অন্য ইভি নির্মাতাদেরও তাদের কৌশলকে ব্যাপকভাবে উন্নত করতে হবে। এটি এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে চীন সরকারের নেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্চ্ছে।
চীনে টেসলার অবস্থান আরো বেশি দৃঢ় হওয়ার সঙ্গে মাস্ক যদি শি জিনপিংয়ের পছন্দের বিদেশী বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠেন, তবে তা মোটেই অবাক করা ব্যাপার হবে না। অন্যদিক থেকে মাস্কের জন্য একটু অস্বস্তিও আছে। ১৯৯০-এর দশকের পর চীন-মার্কিন সম্পর্ক এখন শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পর জো বাইডেনের শাসনকালেও হয়তো সেই ধারা অব্যাহত থাকবে; যা কিনা নিজের ঘরেই বিপাকে ফেলতে পারে মাস্ককে।