যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা নতুন ধরনের ভ্রমণ শুরু করেছেন, তবে তা অবসর যাপন বা পেশাগত কাজে নয়। বরং এই ভ্রমণকে ভ্যাকসিন পর্যটন বলাটাই বরং সঠিক।
ভ্যাকসিন গ্রহীতা হিসেবে নিবন্ধনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চালু করা হয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ওয়েবসাইট। কিন্তু, এসব সাইট ক্র্যাশ করছে প্রতিনিয়ত। আবার একেক শহর বা রাজ্যে রয়েছে টিকাপ্রাপ্তির গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ভিন্ন রকমের নিয়মকানুন। অনেকেই এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ফলে নিজ শহর ছেড়ে অন্যখানে প্রাণদায়ী টিকার সন্ধানে ভ্রমণ করছেন; সময় এবং অর্থের সঙ্কট নেই এমন অনেক ব্যক্তি ও তাদের পরিবার-পরিজন।
ব্যাংকিং জায়ান্ট সিটিগ্রুপের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ৭২ বছরের রিচার্ড পার্সনস তাদেরই একজন। চলতি মাসে তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে সস্ত্রীক মিয়ামিতে যান। তিনি জানান, নিজ রাজ্য নিউইয়র্কে জরুরিভাবে টিকাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা গ্রহণযোগ্য না হলেও, মিয়ামিতে গিয়ে সহজেই টিকা পেয়ে যান। সেখানে ৬৫ বছর এবং তার চেয়ে বেশি বয়স্কদের কোনো প্রশ্ন না করেই টিকার ডোজ ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে।
“প্রথমে কারা টিকা পাবে সেব্যাপারে ফ্লোরিডা খুব সহজ সীমারেখা ঠিক করেছে। তাই আমরা অনলাইনে রাজ্যটির জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিচালিত সাইটে গিয়ে টিকাগ্রহণের তারিখ আগাম বুকিং দেই। এরপর আর কিছু করতে হয়নি,” বলছিলেন পার্সনস। তিনি ও তার স্ত্রী দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার জন্যেও ফ্লোরিডাকে বেছে নিয়েছেন।
তবে তিনি উল্লেখ করেন, “আমার মতো বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষ তো আর ফ্লোরিডায় গিয়ে টিকা নিতে পারবেন না। আর এটা কোনো কার্যকর সমাধানও নয়।”
তবে টিকার তাড়না শুধু ফ্লোরিডায় ভিড় বাড়াচ্ছে, এমনটা নয়। বরং ভ্যাকসিন পর্যটকেরা হাওয়াই রাজ্যের সমুদ্র সৈকত তীরবর্তী রিসোর্ট, কলোরাডোর স্কিয়িং এর জন্য বিখ্যাত শহরগুলো এবং নিউইয়র্ক শহরেও আসছেন। নিউইয়র্ক রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডোজ বরাদ্দ পেয়েছে নিউইয়র্ক শহর। এমনকি তা পাশের দুটি রাজ্য নিউজার্সি এবং কানেকটিকাটের চাইতেও বেশি।
আসলে নানা রকম নিয়মের কারণেই, যেখানে যার বয়স ও শারীরিক অবস্থার কারণে টিকাপ্রাপ্তির সুযোগ বেশি সেখানেই যাচ্ছে মার্কিন ভ্রমণকারীরা।
টিকা পর্যটন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কিছু অঙ্গরাজ্যের রাখা হিসাব অনুসারে ইঙ্গিত মিলছে যে, লাখ লাখ মার্কিনী টিকার সন্ধানে ভ্রমণ করছেন। গত মঙ্গলবার নাগাদ ফ্লোরিডায় ভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ৩৭ হাজার পর্যটক টিকা নিয়েছেন, বলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়। তবে ভিন্ন রাজ্যে বাস করলেও ফ্লোরিডায় নিজস্ব বাড়ি বা ব্যবসা রয়েছে, তাদের সংখ্যা এই পরিসংখ্যানে রাখা হয়নি। হলে সংখ্যাটি আরও বেশি হতো। এপর্যন্ত ফ্লোরিডায় মোট ১০ লাখ ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
ইলিনয়ে রাজ্য বহির্ভূত ১৪ হাজার মার্কিনী টিকা নিয়েছেন। নিউইয়র্ক শহরে এই সংখ্যা ৫৯ হাজার এবং ওয়াশিংটনে ২২,১৫০ জন।
ব্লুমবার্গ ভ্যাকসিন ট্র্যাকার অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে এপর্যন্ত ১৫ মিলিয়ন ডোজ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত বেশি মানুষকে কম সময়ে টিকার আওতায় আনা যাবে, ততই ভালো। কিন্তু, ভ্যাকসিন পর্যটনের কারণে এখন উঁকি দিচ্ছে নতুন শঙ্কা। প্রশ্ন উঠছে, যাদের ভ্রমণ করার আর্থিক সঙ্গতি নেই বা অসুস্থতার কারণে যাত্রা করতে পারবেন না – তারা কী সময়মতো ডোজ পাবেন?
তাছাড়া, আরেক রাজ্য বা শহরে গিয়ে টিকা নিয়ে; ওই এলাকার বাসিন্দাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে কিনা- নৈতিকতার এমন প্রশ্নও উঠছে। বাস্তবতা হলো; সাম্প্রতিক সময়ে এমন ভ্রমণের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, আর পর্যটন শিল্প এ থেকে লাভবান হলেও কর্তৃপক্ষের নীতি-পরিবর্তন এড়াতে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রচারণায় উৎসাহী নয়। অর্থাৎ, অনেকটাই আড়ালে চাপা পড়ছে ইস্যুটি।
গত মঙ্গলবার ৬৫ থেকে তার বেশি বয়োবৃদ্ধদের টিকাপ্রাপ্তির গ্রহণযোগ্যতা ঘোষণা করে নিউইয়র্ক শহর। এসময় নগর মেয়র বিল ডি ব্লাসিও সতর্ক করে বলেন, তার শহরে বরাদ্দ করা চালান প্রায় শেষের পথে। অচিরেই নতুন চালান না আসলে আগামী বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) থেকে টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ রাখতে হবে।
নিউইয়র্ক শহরে মোট যতগুলো ডোজ দেওয়া হয়েছে তার এক-চতুর্থাংশ নিয়েছেন স্থায়ী অধিবাসী নন, এমন ব্যক্তিরা। নগর পরিসংখ্যান মারফত গত ১২ জানুয়ারিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মেয়র ব্লাসিও এতথ্য জানান। তিনি এই প্রবণতাকে আসল উদ্বেগের কারণ বলেও উল্লেখ করেন এবং যারা নগরীর মূল পাঁচটি অঞ্চলের বাসিন্দা বা জরুরি কর্মী -নন তাদের সেখানে এসে টিকা না নেওয়ার অনুরোধ করেন।
ভ্যাকসিন নিতে এই ভ্রমণের ঘটনা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যাপক ম্যারিসসা জে. লেভিন বলেন, “স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিক থেকে দেখলে, যতবেশি নাগরিককে আমরা টিকার আওতায় আনতে পারব, জীবাণু সংক্রমণের হার ততো বেশি কমবে। কিন্তু, আমরা এমন পরিস্থিতিতে আছি; যেখানে চাহিদার চাইতে সরবরাহ কম। একারণেই, কিছু মানুষ টিকা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তারা ভাবছেন, অন্যেরা এসে তাদের টিকা নিচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো টিকা আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং সকলেরই তা পাওয়ার অধিকার আছে।”
ন্যায্যতার ইস্যু:
পর্যটকদের কারণে তাদের এলাকায় ডোজ সঙ্কট দেখা দেবে, অনেকেই এমন শঙ্কা করছেন।
তাদেরই একজন ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডো শহরের বাসিন্দা ৭৭ বছরের লুইস মিলার। তিনি অভিযোগ করেন, তিনি এবং তার স্বামী ৮২ বছরের ফ্রাঙ্কলিন টিকার ডোজ পাননি। একারণে, তারা ভ্যাকসিন পর্যটকদের আগমন নিয়ে চিন্তিত বলেও জানান।
“যথেষ্ট পরিমাণে থাকলে, আমরা নিজেদের বরাদ্দটা পেতে পারতাম। আমি তাদের দোষ দেব না। কিন্তু, আমি এখানে বসবাস করেও আগে টিকা পাচ্ছি না। আর এটাই হলো বৈষম্য।”
“আইনত টিকা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তি। কোনো অঞ্চল বা রাজ্যের কর্তৃপক্ষ এর মালিক নয়। তাই স্থায়ী বাসিন্দার বিবেচনায় ডোজ সংরক্ষণ করাটা বেশ কঠিন হবে,” জানান ভার্জিনিয়ার প্রাক্তন জনস্বাস্থ্য কমিশনার অধ্যাপক লেভিন।
স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চলাচল বেশি নিউইয়র্কের মতো এমন শহর বা অন্য টিকাপ্রাপ্তির স্থানে এমন বিধিমালা জারি করা আরও কঠিন বলেও জানান তিনি।
“স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে আপনি নিজ অঞ্চলের জনসংখ্যাকে প্রাধান্য দিতে পারেন। কিন্তু, আপনার শহরে টিকা নিতে এসে কেউ যদি তা না পেয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়, তখন সে দায় আপনাকেই বহন করতে হবে,” লেভিন ব্যাখ্যা করেন।
সূত্র: ব্লুমবার্গ