মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। রক্ত, লালা, কফ, এমনকি স্তন্যদুধেও পাওয়া গেছে এসব ক্ষুদ্র কণা। সম্প্রতি এগুলো হাড়ের ভেতরেও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব কণার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে হতে পারে ভয়াবহ। বিবিসি’র এক গবেষণাধর্মী নিবন্ধে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
ইংল্যান্ডের হার্টফোর্ডশায়ারের রথামস্টেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সংরক্ষিত ১৮৪৩ সাল থেকে সংগ্রহ করা মাটি ও ফসলের নমুনায়ও মিলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। গবেষক অ্যান্ডি ম্যাকডোনাল্ড জানান, ১৯৬০ সালের পর থেকে এসব কণার পরিমাণ বেড়েছে। প্লাস্টিক ব্যবহারের বিস্তার তার জন্য দায়ী।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি বছর গড়ে একজন মানুষ ৫২,০০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা খাচ্ছেন। পানি, খাবার এবং বাতাসের মাধ্যমে এসব কণা আমাদের শরীরে ঢুকছে। ২০২৪ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, ১৯৯০ সালের তুলনায় মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণের হার ছয় গুণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব জানতে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে আটজন স্বেচ্ছাসেবীকে দিয়ে লন্ডনে চালানো হয় একটি পরীক্ষামূলক ট্রায়াল। গবেষণায় দেখা হয়, কীভাবে টি ব্যাগ ডুবানো পানি বা প্লাস্টিক পাত্রে গরম খাবার গরম করলে মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করে। এরপর ১০ ঘণ্টা ধরে তাদের রক্তে এসব কণার গতিবিধি পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণার প্রধান স্টেফানি রাইট বলেন, এই গবেষণা আমাদের শরীরের রক্তে কত পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে তা নির্ধারণে সহায়তা করবে। সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণাগুলোই রক্তে প্রবেশের সম্ভাবনা বেশি।
২০২৪ সালে চীনা গবেষকরা হাড় ও পেশির ভেতর মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পান। তাদের আশঙ্কা, এটি শরীরচর্চার ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। একই বছর ইতালির এক গবেষণায় ধমনির প্লাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। এতে আক্রান্তদের হৃদরোগ, স্ট্রোক বা আকস্মিক মৃত্যুর ঝুঁকি ৪.৫ গুণ বেড়ে যায়।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা মৃতদেহের মস্তিষ্কে মাইক্রোপ্লাস্টিক খুঁজে পান। যাদের ডিমেনশিয়া ছিল, তাদের মস্তিষ্কে প্লাস্টিক কণার পরিমাণ ১০ গুণ বেশি ছিল। গবেষক ম্যাথিউ ক্যাম্পেন জানান, প্লাস্টিক কণা মস্তিষ্কে চর্বি ও শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রবেশ করতে পারে।
তবে সরাসরি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে হৃদরোগ বা ডিমেনশিয়া হয়—এ দাবি করতে রাজি নন গবেষকরা। তাদের মতে, এসব কণা অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে মিলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করে।
এ বিষয়ের জটিলতা বাড়িয়ে তুলেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের বৈচিত্র্য। এক লিটার বোতলজাত পানিতে প্রায় ২,৪০,০০০ কণা থাকতে পারে, যার মধ্যে সাত ধরনের প্লাস্টিক থাকতে পারে। কিছু প্লাস্টিক পরিবেশ থেকে ভারী ধাতু বা বিষাক্ত রাসায়নিক শোষণ করে শরীরে প্রবেশ করাতে পারে। এছাড়া, কিছু প্লাস্টিক অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স জিন বহন করে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি করতে পারে।
অস্ট্রিয়ার গবেষক ভেরেনা পিচলার বলেন, ন্যানোপ্লাস্টিক (১ মাইক্রোমিটারের কম) কোষের ভেতরে ঢুকে সেলুলার ডিএনএ ক্ষতি করতে পারে। এসব ক্ষতিকর কণা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
ইতালির অধ্যাপক রাফায়েল মারফেলা জানান, মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে রক্তনালির সমস্যা, কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহজনিত বার্ধক্য ত্বরান্বিত হতে পারে। তিনি বলেন, ইঁদুরের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরের ওজন অনুযায়ী প্রতিদিন ১০-১০০ মাইক্রোগ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করলে প্রদাহ ও বিপাকীয় পরিবর্তন দেখা দেয়।
তবে মানুষের দেহে এসব প্রভাব কতটা ঘটে তা নির্ধারণ এখনও কঠিন। কারণ মানুষ একাধিক ধরনের ও উৎসের প্লাস্টিক গ্রহণ করে, এবং বয়স বা অন্যান্য অসুস্থতার ওপরেও নির্ভর করে এসব কণার প্রভাব।
ফাই কাউসেইরো, যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক জানান, মাইক্রোপ্লাস্টিক শ্বাসযন্ত্রের রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তিনি এখন হাঁপানি রোগীদের কফ পরীক্ষা করছেন এসব কণার উপস্থিতি ও প্রভাব বুঝতে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের প্লাস্টিক মাস্ক ও টিউবের মাধ্যমেও মাইক্রোপ্লাস্টিক রোগীদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে বিকল্প উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত গবেষকরা চাইছেন মাইক্রোপ্লাস্টিকের নিরাপদ মাত্রা নির্ধারণ করে উৎপাদনকারীদের সচেতন করতে। তাতে হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই নিঃশব্দ দূষণ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা সম্ভব হবে।