spot_img

গুমের ঘটনায় প্রধান ভূমিকা পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি ও সিটিটিসি’র: কমিশনের প্রতিবেদন

অবশ্যই পরুন

দেশে সংঘটিত বেশিরভাগ গুমের পেছনে পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) জড়িত ছিলো। এমন তথ্য উঠে এসেছে গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছেন।

এছাড়া, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটের বিরুদ্ধে গুমে প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের বিরুদ্ধেও গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ডিজিএফআই ও এনএসআই মূলত গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। আইনগতভাবে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করার এখতিয়ার তাদের নেই। অথচ এ সংস্থাগুলোর সদস্যরা যেভাবে আটক, অপহরণ ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, তা সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘনের শামিল। এটি দেশের আইন ব্যবস্থায় সমান্তরাল অবৈধ শক্তি গড়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়।

তদন্ত কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নিজ কার্যপরিধি বা দায়িত্বের সীমা এবং নিয়মনীতি (এসওপি) অমান্য করে অভিযান চালিয়েছে। এটিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

পুলিশের ভূমিকা

পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের মধ্যে রয়েছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে পুলিশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করে নিরপেক্ষ জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বদলে সরকারপন্থী ‘এনফোর্সার’ হিসেবে কাজ করে। সে সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়।

পুলিশের ‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের আগে কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো না। হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়টিও ছিল ব্যাপক। অনেক ভুক্তভোগী মারধর, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে চুবিয়ে রাখা এবং অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতা জানান। যদিও ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধ আইন পাস করে তৎকালীন সরকার, কিন্তু বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এটির প্রয়োগ হয়েছে। অল্প সংখ্যক কর্মকর্তাকে এই আইনের আওতায় বিচার করার হয়েছে।

ছাত্র আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও দমন-পীড়ন চালায় পুলিশ। বিশেষত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হওয়া ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ চলাকালে পুলিশের ভূমিকা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নমত দমনে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কিংবা প্রচার চালানোর মতো অস্পষ্ট অভিযোগে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কমিশনের মতে, বহু রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সরকারের সমালোচকদের গুম করেছে পুলিশ। তাদের অনেককেই নির্যাতনের পর বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

র‌্যাব: আইন রক্ষা বাহিনী থেকে দমনযন্ত্রে রূপান্তর

র‌্যাব প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে থাকে।

তদন্ত কমিশন শত শত অভিযোগ পেয়েছে, যেখানে র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, র‌্যাবের হাতে আটক হওয়া অনেক ব্যক্তিকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এতে বাহিনীটির আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়টি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি হয়।

র‌্যাব গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বাহিনীটিকে সন্ত্রাসবাদ দমন বাহিনী হিসেবে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু পরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনকারী ডেথ স্কোয়াডে পরিণত হয় র‌্যাব। বাহিনীটি শুরু থেকেই ব্যাপক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেছে। তবে তাদের কার্যক্রমে পর্যাপ্ত তদারকির অভাব থাকায় নির্যাতনের সুযোগ তৈরি করে দেয়।

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সঙ্গে সমন্বয় করে গোপন অভিযান চালাত। এসব অভিযানে সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান দমনের নামে বহু অপহরণ ও গোপন স্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখা হতো।

টিএফআই সেলে হাজার হাজার মানুষকে দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস ধরে অন্ধকার কক্ষে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখা হতো। ৩৮টি সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, এ কেন্দ্রে বন্দিদের পিটিয়ে, বিদ্যুৎ শক দিয়ে, উল্টে ঝুলিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে বা এমনকি শরীরের অঙ্গ ছিঁড়ে নির্যাতন করা হতো। শিশু ও মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরাও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি।

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে র‌্যাব গোয়েন্দা বা স্থানীয় ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে সরাসরি অপহৃত বা ডিজিএফআই-এর হেফাজত থেকে আনা ব্যক্তিদের এ সেলে আনা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো, যাতে খোঁজ ও শনাক্তকরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর র‌্যাব বাহিনী সেলের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করতে সক্রিয় হয়। নির্যাতনের প্রমাণ মুছে ফেলতে সেলগুলোর গঠন বদলে বড় করা হয়, নির্যাতন কক্ষ ভেঙে ফেলা হয়, নজরদারি ক্যামেরা খুলে ফেলা হয় এবং ফরেনসিক প্রমাণ নষ্ট করতে মেঝের টাইলস পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলা হয়। এটি ছিল প্রমাণ নষ্ট করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ শুধু অপরাধ দমনের বাইরে যাওয়ার নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ারও। বিরোধী দল, মানবাধিকারকর্মী ও ভিন্নমতের মানুষদের ওপর দমন-পীড়নে র‌্যাবকে ব্যবহার করা হয়। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, র‌্যাব সদস্যরা জানতেন যে তাদের বিচার হবে না। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি তাদের বেপরোয়া করে তোলে বলে অভিযোগ তাদের।

সরকার পরিবর্তনের পরও র‌্যাব নামে বাহিনীটি এখনো টিকে আছে। তবে র‌্যাবের অতীত কার্যক্রম ও জনমনে তৈরি করা ভয় ও অনাস্থা এখনো গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে বড় বাধা হয়ে আছে।

কমিশন মনে করে, সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে র‌্যাব বাহিনীটি পুরোপুরি বিলুপ্ত করা দরকার। এটি না হলে দায়মুক্তির চক্র বন্ধ হবে না, জনআস্থা ফিরবে না এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়া সম্ভব হবে না।

বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করে এসব তুলে ধরা হয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ

সুপার ফোরে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে কি হাত মেলাবেন ক্রিকেটারেরা? যা জানালো আইসিসি

এশিয়া কাপের সুপার ফোরে জায়গা করে নিয়েছে পাকিস্তান। বুধবার দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ৪১ রানে হারিয়ে নিশ্চিত...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ