ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতৃ সিংহাসনে আরোহন করেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক অভিযানে সফলতা লাভের পর ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি সালতানাতের স্থলে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
মোগল সাম্রাজ্য : মোগল সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রাথমিক আধুনিক সাম্রাজ্য। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পশ্চিমে সিন্ধু অববাহিকার বাইরের প্রান্ত থেকে, উত্তর-পশ্চিমে উত্তর আফগানিস্তান এবং উত্তরে কাশ্মীর, পূর্বে বর্তমান আসাম ও বাংলাদেশের উচ্চভূমি এবং এর উচ্চভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দক্ষিণ ভারতের দাক্ষিণাত্যের মালভূমি।
বাবরি মসজিদ নির্মাণ : মোগল শাসকদের আমলে ভারতবর্ষে অংখ্য শিল্প, স্থাপত্য গড়ে উঠে। মোগলস্থাপত্যের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য হলো স্থাপত্যে গম্বুজের ব্যবহার। সম্রাট জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর ১৫২৭ সালে অযোধ্যার নিয়ন্ত্রণ নেন তার সেনাপতি মীর বাকি। পরের বছর ১৫২৮ সালে সম্রাট বাবরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সরযূ নদী পাড়ে নির্মাণ করেন তিন গম্বুজবিশিষ্ট এক মসজিদ। সাড়ে চার শতক পরে যা ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠে।
সেনাপতি মীর বাকি বাবরি মসজিদ নির্মাণের ৩৫৭ বছর পর ১৮৮৫ সালে মসজিদটি নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক ও আইনি লড়াই। তিন গম্বুজওলা ওই মসজিদ শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থান ভেঙেই তৈরি হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন হিন্দুদের একটা বড় অংশ। তারা বলতেন, মসজিদের ভেতরে থাকা একটা উঁচু বেদীর মতো অংশেই রাম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, মোগল আমলে একাধিকবার ওই জমি উদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল। যদিও সেই দাবির সমর্থনে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণও মেলেনি।
১৯৫৯ সালে হিন্দুদের পক্ষে জমি চেয়ে মামলা করেন নির্মোহী আখড়া নামের এক ব্যক্তি। অপরদিকে ১৯৬১ সালে মসজিদের জমির মালিকানা দাবি করে মুসলমানদের পক্ষে আদালতের দারস্থ হন উত্তর প্রদেশ মুসলিম ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৮০-র দিকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগী কট্টোর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা ওই স্থানে রাম মন্দির নির্মানে প্রচারাভিযান চালায়।
মিছিল বের করে লাল কৃষ্ণ আদভানি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দেড় লাখ কর সেবক নিয়ে একটি শোভাযাত্রা বের করে। এ শোভাযাত্রা চলাকালীন সময়ে উগ্রবাদী হিন্দুরা সহিংস হয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত এ মসজিদটি শহীদ করে। যা মুসলমানদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে।
পরবর্তীকালের অনুসন্ধানে এই মসজিদ ভাঙার অপরাধে ৬৮ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে, যাদের অধিকাংশই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপির নেতা বলে জানা যায়। ৩ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে সংসদে পাশ হওয়া এক আইনের মাধ্যমে এ জমি দখল করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া ও রামলালা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে এই তিনভাগে জমিটি ভাগ করার রায় দেয় এলাহাবাদের তিন বিচারকের বেঞ্চ। কিন্তু ২০১১ সালের ৯ মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় এবং ৯ নভেম্বর শনিবার ২০১৯ অযোধ্যার এ জমিটিতে হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের রায় দেয় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট।
একইসঙ্গে মসজিদ নির্মাণের জন্য মুসলিমদের বিকল্প ৫ একর জমি দেওয়ার রায় দেওয়া হয়। রাম মন্দির উদ্বোধনের কাজ শুরু হলেও সেই মসজিদ নির্মাণের কাজে কোনো অগ্রগতি ছিল না। তবে নতুন করে মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

