আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। যদিও তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে যদি একমত না হওয়া যায়, তাহলে আমার শঙ্কা হচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা যে জায়গায় দাঁড়াব, তাতে মৌলিক কোনো হেরফের ঘটবে না।’
শনিবার এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে আলী রীয়াজ এ কথাগুলো বলেন। ‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শিরোনামে এ বৈঠকের আয়োজনে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমি বারবার আহ্বান করেছি। তারা যথেষ্ট পরিমাণে সাড়া দিয়েছেন, কিন্তু কোনো না কোনো সময় তো প্রক্রিয়াটা শেষ করতে হবে, এটা তো অনিঃশেষ প্রক্রিয়া হতে পারে না। সেক্ষেত্রে নির্বাচনটা করতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে কেবল অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, তা নয়; জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আমি তা-ই মনে করি। সেই কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন এই জিনিসটা মোকাবিলা করা।’
আলী রীয়াজ বলেন, আগামী নির্বাচনটি আমরা করছি এ কারণে যে রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রে কতগুলো পরিবর্তন আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সংস্কার কমিশনে কাজ করার সময় আমরা দেখেছি, গত ১৬ বছরের যে সংকট, সেটা ১৬ বছরের সংকট নয়। ১৬ বছরের সংকটের ভয়াবহতাটা আমরা দেখতে পেয়েছি, কারণ একটা ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে আমরা বিভিন্নভাবে এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি।
তিনি বলেন, এখন যদি আমরা ওই কাঠামোটা ঠিক রাখি, একেবারেই সামান্য পরিবর্তন করি, আপনি নির্বাচন করে কোথায় যাবেন? একজন বিজয়ী হবে, একটি দল ক্ষমতায় যাবে, দেশ শাসন করবে? আমরা একটা কনসলিডেটেড ডেমোক্রেসি চাই। তিন দফা (১৯৭৩, ১৯৯১ ও ২০০৯) চেষ্টা করেও যেটা আমরা এটা পাইনি। কাঠামোগত পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে যদি একমত না হওয়া যায়, তাহলে আমার শঙ্কা হচ্ছে, পরবর্তী সময় আরেকটা নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা যে জায়গায় দাঁড়াব, তাতে মৌলিক কোনো হেরফের ঘটবে না।
শেখ হাসিনার ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং এর পরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা ফ্র্যাগমেন্টেড হয়েছে। এর কারণেই পার্থক্যগুলো তৈরি হয়েছে। আমরা কী চাই সেটা যদি স্পষ্ট হয় এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, তাহলে আমার ধারণা এই জায়গায় আসা যাবে।
গোলটেবিল বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ শুরু হয়েছিল গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। বাংলাদেশের ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সংবিধান, শাসনব্যবস্থা, আইনি প্রক্রিয়া-বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে মত বিনিময় করেছেন। এই মতবিনিময়ের সময় পরস্পরের সহিষ্ণু থেকেছেন, এটা আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক। আমি ইউজুয়ালি পেরেনিয়ালি আশাবাদী। অনেকে বলেছেন যে ভাই ভারী চেয়ার রাখেন, না হলে রাজনীতিবিদরা পরস্পরের দিকে চেয়ার ছোড়া শুরু করবেন। কিন্তু আমি বলেছি, তারা এটা করবে না, তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে চান।
আর দুদিন তাদের মেয়াদ আছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, আমরা এখন যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেটা হচ্ছে ৮৪টা বিষয়ে একমত হওয়া গেছে। তবে সব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন, তা নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যে ৬৪টা বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার মধ্যে কারও কারও ছোটখাটো আপত্তি বা ভিন্নমত আছে। আমরা প্রথম পর্যায়ে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টা রাখিনি।… পরবর্তী সময় যে ২০টা বিষয়, সেখানে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে মতভিন্নতা বেশ বড় রকমের দূরত্ব তৈরি করেছে। ওই ২০টার মধ্যে ১১টা তো ডিসাইডেড। এর মধ্যে শুধু একটি আছে, যেখানে একটি মাত্র দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
এ সময় সংবিধান প্রসঙ্গে আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান এখনো যে পরিস্থিতিতে আছে, আমরা সংবিধানের মধ্যেই আছি। এই অর্থে যে অনুচ্ছেদ ১০৬ দিয়েই এই সরকার গঠিত হয়েছে। এটা কমিশনের বক্তব্য নয়, আমার ব্যক্তিগত মত। যদি পুরো সংবিধানের মধ্যেই আমরা থাকতাম, তাহলে কি আমরা এখানে এসে বসে আলোচনা করতাম, তাহলে কি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৈরি হতো, তাহলে কি ১১টা সংস্কার কমিশন হতো, আমরা সংবিধান নিয়ে কথাবার্তা বলতাম? বলিনি তো। তাহলে একটা কিছু ঘটে গেছে, যে কারণে এই প্রশ্নগুলো ওঠে। এটাকে স্বীকার করে এগোনো যায়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, পথ বের করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ছয়টা পথ দিয়েছে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা দুটো পথের কথা বলছেন। যেগুলো সংবিধানের বাইরে, সেগুলো তো সবাই একমত হলে অর্ডিন্যান্স বা অর্ডার দিয়ে করার বিষয়ে কারও কোনো মতভিন্নতা নেই। মতভিন্নতা আছে সংবিধানসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে, যেগুলো নির্বাহী ক্ষমতাকে রেস্ট্রেইন করবে, জবাবদিহি তৈরি করবে এবং কোনো না কোনোভাবে এই ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করবে যে জনগণের যে মৌলিক আকাঙ্ক্ষা, সেটাকে নিশ্চিত করবে। সেটা হলো আমরা আরেকটা শেখ হাসিনা চাই না। এই জায়গা থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে এই জায়গায় আসার পথ খুঁজতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন এসময় উপস্থিত ছিলেন।
ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে আজাদ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফাও উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে।