প্রকৃতির নির্মম পরিহাস, যে মানুষটি মাত্র একদিন আগে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের হতাশা প্রকাশ করেছিলেন, সেই আবুল কালাম রোববার মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডের নিচে চাপা পড়ে মারা গেলেন। তার শেষ ফেসবুক পোস্ট এখন হয়ে উঠেছে মর্মস্পর্শী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
মৃত্যুর পরপরই আবুল কালামের ওই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। রিমু রোজা খন্দকার নামে একজন তা শেয়ার করে লিখেছেন, “মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিল আবুল কালাম। মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে, আবুল কালামের ইচ্ছে পূরণ করে দেয় রাষ্ট্র।”
নিজের ফেসবুক পেজে আবুল কালাম লিখেছিলেন, “ইচ্ছে তো অনেক আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।” সেই পোস্টের সঙ্গে তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানের সঙ্গে একটি সেলফিও যুক্ত করেছিলেন।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই তার স্বজনরা ছুটে আসেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে। নিহতের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, “আজকে আমি ওকে বিদায় দিতে চাইনি, দরজা লাগাতেও যাইনি। আমার বাচ্চাদের এখন কে দেখবে?”
নিহতের পারিবার সূত্রে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে আবুল কালাম ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন। নিয়মিত ব্যবসায়িক কাজে ফার্মগেট এলাকায় যাতায়াত ছিল তার।
নিহতের মেঝ ভাবি আছমা বেগম বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে কালামের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল। বলেছিল, দু’এক দিনের মধ্যে বাড়ি আসবো, তুমি ইলিশ মাছ কিনে রেখো। কিন্তু ভাই আর বাড়ি ফিরল না।’
চাচাতো ভাই আব্দুল গণি মিয়া চোকদার জানান, ‘কালাম খুব ভদ্র ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলো। নিজের চেষ্টায় ঢাকায় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিল। এমন দুর্ঘটনা সরকারের অবহেলার কারণেই ঘটেছে। এখন ওর সংসার কীভাবে চলবে?’
নিহতের পরিবার আরও জানায়, আবুল কালামের ৫ বছরের এক ছেলে সন্তান আব্দুল্লাহ ও ৩ বছরের কন্যা সুরাইয়া আক্তার রয়েছে। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি এখন নিঃস্ব অবস্থায় পড়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হঠাৎ করেই মেট্রোরেল পিলারের ওপর থেকে ভারী ধাতব (বিয়ারিং প্যাডটি) নিচে পড়ে যায়। সেটি কালামের মাথায় আঘাত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সড়ক ও রেলপথ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, নিহতের পরিবারের প্রতি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এছাড়া পরিবারের কর্মক্ষম কাউকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল কাইয়ুম খান বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবারটিকে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেয়া হবে।
নিহতের প্রতিবেশীরা বলছেন, কালাম ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী ছিল। পরিবারের হাল ধরেছিল সে-ই। এখন তার শিশুসন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে? শেষ ফোনে বলেছিলেন, ইলিশ মাছ কিনে রেখো ভাবি। তারপরই চিরতরে নীরব হয়ে গেলেন শরীয়তপুরের তরুণ ব্যবসায়ী আবুল কালাম।
রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনের নিচে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে ফুটপাতে হাঁটছিলেন আবুল কালাম। হঠাৎ ওপর থেকে ভারী ইলাস্টোমোরিক বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে তার মাথায় আঘাত লাগে এবং ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
আবুল কালামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। তার বাবার নাম জলিল চোকদার। তিনি পেশায় ট্রাভেল এজেন্সিতে এয়ার টিকিট বিক্রির কাজ করতেন এবং পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জে বসবাস করতেন।

