ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে গত সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তির রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। আইনপ্রণেতারা হাসেন, করতালি দেন এবং দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানান।
তবে এই নাটকের আড়ালে ছিল তথ্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ও ধোঁয়াশা। ট্রাম্পের বক্তৃতায় ৭ অক্টোবরের হামলা থেকে শুরু করে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, হিজবুল্লাহ, মার্কিন রাজনীতি, ইসরায়েল ও তার নিজের শান্তি নায়ক ভাবমূর্তি গঠনের প্রচেষ্টায় একের পর এক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর দাবি ছিল।
একজন ইসরায়েলি সংসদ সদস্য ওফের কাসিফ, যিনি বক্তৃতার সময় প্রতিবাদ করায় নির্মমভাবে হেনস্তা হয়ে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে ফেসবুকে লিখে এ দিনের বিরাট পরিহাস তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, “যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর মিথ্যা ভাষণের সময় আমি সত্য পড়ে নিচ্ছিলাম।”
তিনি তখন পড়ছিলেন বিশিষ্ট ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পাপে-এর “দ্য এথনিক ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন”, যা ছিল এক প্রতীকী নীরব প্রতিবাদ, যখন ট্রাম্প, নেতানিয়াহু এবং গাজায় গণহত্যার অন্যান্য প্রধান নকশাকারীরা প্রায় ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি হত্যার উৎসবে নিজেদের অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন।
১. প্রথমত ট্রাম্প ইরান নিয়ে মিথ্যাচার করেন। তিনি বলেন, “আমরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ১৪টি বোমা ফেলে সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছি। এটা নিশ্চিত হয়েছে।” পেন্টাগনের রিপোর্ট অনুযায়ী, এসব হামলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করেনি। মূল যন্ত্রপাতি প্রায় অক্ষত ছিল।
২. ট্রাম্প বলেন, “আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র পাওয়া থেকে সন্ত্রাসে অর্থায়নকারী প্রধান রাষ্ট্র ইরানকে থামিয়েছি।” মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে না। আয়াতুল্লাহ খামেনি এক ধর্মীয় ফতোয়ায় গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিষিদ্ধ করেছেন।
৩. তিনি বলেন, “ইরান এখন শান্তি চায়, তারা টিকে থাকতে চায়।” খামেনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
৫. মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক সন্ত্রাসী হামলায় আক্রান্ত হয়েছেন।” অথচ ৭ অক্টোবরের আল-আকসা ঝড় ছিল বছরের পর বছর ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিজের বন্দিদের হত্যা করেছে বলে হারেৎজ রিপোর্ট করে।
৬. ট্রাম্প বলেন, “যুদ্ধ থেমেছে, বন্দি ফেরত এসেছে — এ এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা।” অথচ গাজায় কোনো লক্ষ্য পূরণ হয়নি। হামাস ধ্বংস হয়নি, বন্দিরাও ফেরত আসেনি।
৭. তিনি বলেন, “গাজাবাসীদের এখন শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া উচিত।” কিন্তু ৭ দশক ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করছে। ২০ হাজারের বেশি শিশু নিহত হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার শিশুর অঙ্গহানি হয়েছে।
৯. তিনি বলেন, “এই যুদ্ধ শেষ হয়েছে—কেউ বলে ৩ হাজার বছর, কেউ বলে ৫০০ বছর।” কিন্তু এই দখলদারিত্বের শুরু ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায়। ব্রিটেন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়, যার ফলে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ঘটে।
১০. ট্রাম্প বলেন, “সমগ্র অঞ্চল গাজা নিরস্ত্রীকরণে রাজি হয়েছে।” হামাস জানিয়েছে, কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র সমর্পণ করা হবে না।
১১. তিনি বলেন, “তোমরা জিতে গেছো (ইসরায়েল)।” আসলে ইসরায়েল পরাজিত হয়েছে। হামাস টিকে আছে, বন্দিরা ফেরেনি, আর বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে পড়েছে।
১২. মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “ইসরায়েল শান্তি চেয়েছে।” আসলে ইসরায়েল বারবার যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে।
১৩. তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের মতো এখানেও সোনালি যুগ শুরু হবে।” কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে চলছে অচলাবস্থা, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, বিদেশনীতি ব্যর্থতা।
১৪. ট্রাম্প বলেন, “ওবামা ও বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে ঘৃণা করতো।” অথচ এই দুই প্রশাসন ইসরায়েলের জন্য বিপুল সামরিক সহায়তা দিয়েছে। বাইডেন নিজেকে গর্বিত জায়োনিস্ট বলেছেন।
১৫. ট্রাম্প বলেন “আমি ৮টি যুদ্ধ ৮ মাসে মিটিয়েছি।” অথচ এসব ছিল ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি। বাস্তবে ট্রাম্পের আমলেই ইরান, ভেনেজুয়েলা ও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
১৬. তিনি, “ইসরায়েলে সবাই একসাথে ভালোবাসায় থাকে—এটা এক আধুনিক বিস্ময়।” অথচ আন্তর্জাতিক আদালত বলেছে, ইসরায়েল জাতিগত বৈষম্য ও অ্যাপার্থাইড চালাচ্ছে। মুসলমান, খ্রিস্টান, আরর—সবাই নিপীড়নের শিকার।
১৭. ট্রাম্প বলেন, “ইসরায়েল এখন সবচেয়ে বেশি সম্মান পাচ্ছে।” কিন্তু বাস্তাবতা হলো বিশ্বজুড়ে ইসরায়েল বয়কট, প্রতিবাদ ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়েছে। জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর বক্তৃতার সময় বহু প্রতিনিধি ওয়াকআউট করেছে।
সূত্র: প্রেস টিভি