ঘুম আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ এই অনুগ্রহের কথা বলেছেন। যেন মানুষ তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি বিশ্রাম, রাতকে করেছি আবরণ এবং দিনকে করেছি জীবিকা আহরণের সময়।’ (সুরা নাবা, আয়াত : ৮-১১)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার কথা বলার পর প্রশান্তি লাভের মাধ্যমগুলোর মধ্যে ঘুমের আলোচনা সর্বপ্রথম করেছেন। ঘুম হলো মানুষের বিশ্রাম ও প্রশান্তির লাভের একটি মৌলিক মাধ্যম। তিনি ঘুমের অনুগ্রহ তিনি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, মূর্খ, শাসক ও শ্রমিক সবাইকে তিনি ঘুমের দৌলত দান করেছেন এবং তা লাভের জন্য একই সময় নির্ধারণ করেছেন। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) লেখেন, আল্লাহ তাআলা ‘সুবাতান’ শব্দ দ্বারা ঘুমকে বিশেষায়িত করেছেন। সুবাত অর্থ মুণ্ডন করা, কর্তন করা। আল্লাহ ঘুমকে এমন জিনিস বানিয়েছেন যা মানুষের যাবতীয় উদ্বেগ, ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়। ফলে সে এমন প্রশান্তি লাভ করে কোনো কিছুই যার বিকল্প হতে পারে না। এজন্য কেউ কেউ সুবাতের অনুবাদ করেছেন বিশ্রাম শব্দ দ্বারা।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষ যতটুকু ঘুমাতে পারে, ধনী ও সমাজপতিরা ততটুকু ঘুমাতে পারে না। তাদের কাছে আরাম ও বিশ্রামের সব উপায়-উপকরণ আছে, তারা শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসবাস করে, তারা নরম বিছানায় ঘুমায়—যা দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে, তবে ঘুম এসব উপকরণের অনুগামী নয়। ফলে তারা অনুকূল সবকিছু থাকার পরও ঘুমাতে পারে না। এই অনুগ্রহ সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে আছে। কখনো কখনো নিঃস্ব ব্যক্তিকে কোনো বিছানা ছাড়াই খোলা জায়গায় ঘুমে আচ্ছন্ন হতে দেখা যায় আবার কখনো তার সব উপকরণ থাকার পরও ব্যক্তিকে তা দেওয়া হয় না। তারা ওষুধ খেয়ে ঘুমায়। কখনো কখনো ওষুধও কাজ করে না।
মহান আল্লাহ ঘুমের অনুগ্রহ সব মানুষ ও প্রাণীর জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ফলে প্রাণিকূল বিনা কষ্টে ও বিনা মূল্যে তা লাভ করে। আল্লাহর তার চেয়ে বড় অনুগ্রহ হলো তিনি ঘুমকে প্রবল ও বাধ্যতামূলক করেছেন। মানুষ অনেক সময় কাজের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বাধ্য হয়ে রাত জেগে কাজ করতে চায়। কিন্তু দয়ালু আল্লাহ তাঁর ওপর ঘুম চাপিয়ে দেন। সে অনিচ্ছায় ঘুমিয়ে যায়। এতে তার সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় এবং সে দ্বিগুণ কর্মশক্তি লাভ করে।
আল্লাহ বলেছেন, রাতকে আমি আবরণ করেছি। এই বাক্যে ইঙ্গিত মেলে সাধারণত তখনই মানুষের ঘুম আসে যখন আলো বেশি থাকবে না, চারদিকে নিরবতা থাকবে, কোনো হট্টগোল হবে না। মূলত এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ বলেছেন যে, আমি তোমাদেরকে শুধু ঘুম দান করিনি, বরং ঘুমের উপযোগী রাত সৃষ্টি করেছি। তখন সমগ্র সৃষ্টিকে আমি এমন ব্যবস্থাপনার অধীন করেছি যেন তোমাদের ঘুমের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এখানে দুটি বিষয়ের মাধ্যমে আল্লাহ ঘুম অনুগ্রহকে পূর্ণতা দান করেছেন। তা হলো, সকল মানুষ ও প্রাণীকে ঘুম দান করা এবং একই সময় সবার ওপর ঘুম প্রবল করে দেওয়া। কেননা যদি সব মানুষ ও প্রাণীর ঘুমের সময় একই না হতো তবে ঘুমের পরিবেশ বিঘ্নিত হতো এবং মানুষ ঘুমিয়ে শান্তি পেত না।
এরপর আল্লাহ বলেছেন, আমি দিনকে জীবিকা নির্বাহের সময় করেছি। মানুষের জীবনে শান্তি ও তৃপ্তি লাভের জন্য জীবিকাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুবা ঘুম মৃত্যুতে পরিণত হবে। যদি পুরো সময় রাত (অন্ধকারে আচ্ছন্ন) হতো এবং মানুষ সব সময় ঘুমিয়ে থাকত তবে তারা কিভাবে জীবিকা অর্জন করত। জীবিকা অর্জনের জন্য চেষ্টা ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। যার জন্য আলো প্রয়োজন। কেমন যেন আল্লাহ বলছেন, তোমাদের শান্তি ও সুখের জন্য আমি শুধু রাতের আঁধার সৃষ্টি করিনি, বরং আমি দিনের আলোও সৃষ্টি করেছি। যেন তোমরা তোমাদের চেষ্টা ও শ্রমের মাধ্যমে জীবিকার প্রয়োজনও পূরণ করতে পারো। সত্যিই মহান আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি অতি দয়ালু।
আধুনিক বিজ্ঞানও পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা বলেন, ঘুমের মাধ্যমে আমাদের শরীর জীবাণু মুক্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো মেরামত হয়, এবং আমরা পরের দিন নতুন করে কাজ করার শক্তি সঞ্চয় করি। যদি কেউ পর্যাপ্ত না ঘুমায়, কম ঘুমায়, বা শান্তিময় ঘুমের অভাব থাকে, তাহলে সে দ্রুত মানসিক ও শারীরিক রোগের শিকার হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কেউ ১৭-১৯ ঘণ্টা ধরে জেগে থাকে, তাহলে তার চিন্তা-ভাবনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মদ্যপ অবস্থার সমান। চিকিত্সা বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুমানো, রাতভর জেগে থাকার ফলে মানুষের মানসিকতা, চিন্তাধারা, আচরণ এবং মনস্তত্ত্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষ দিনে জীবিকা অনুসন্ধান করবে এবং রাতে আরাম করবে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে এমন নির্দেশনাই দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই তাঁর দয়ায় তোমাদের জন্য করেছেন রাত ও দিন, যেন তাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পারো এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো। আর (আল্লাহর) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৩)
তাফসিরবিদ আলেমরা বলেন, আয়াতে আল্লাহ মূলত উত্তম জীবনধারা তুলে ধরেছেন। রাতের ঘুম এবং দিনের কাজ মানুষের সুস্থতা ও মানবপ্রকৃতির অনুকূল। তবে এর অর্থ এই নয় যে, দিনে ঘুমানো এবং রাতে ব্যবসা করা, চাকরি করা বা অন্য কোনো কাজ করা নাজায়েজ। রাতে কাজ করে দিনে ঘুমানোর অবকাশও আছে। কখনো কখনো রাতে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। যেমন পাহারাদারি। একইভাবে যখন দিন ছোট থাকে তখন দিনে কাজ শেষ করা যায় না, রাতে কাজ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এমন অনেক কাজ আছে রাতে বন্ধ রাখা যায় না। যেমন পণ্য উত্পাদনের স্বয়ংক্রিয় বড় মেশিন। এগুলো পরিচালনার জন্য দিনের মতো রাতেও লোক প্রয়োজন হয়। ফলে কেউ রাতে কাজ করে দিনে ঘুমালে তাকে গুনাহগার বলার সুযোগ নেই। তবে সুযোগ থাকলে রাতের কাজ পরিহার করাই উত্তম। কেননা গবেষণায় দেখা গেছে, রাতের শিফটে কাজ করা ৯৭ শতাংশ কর্মী কয়েক বছর কাজ করার পরও তাদের কাজের রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। এর ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মাআরেফুল কোরআন অবলম্বনে