কাশ্মিরের পেহেলগাম ইস্যুর জেরে দৃশ্যমান সংঘাতে জড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান। ঠিক সেই সময়ে ভারতীয় প্রথম সারির ও ‘বিশ্বস্ত’ কিছু গণমাধ্যমও তথ্য যাচাই না করার পাশাপাশি বানোয়াট প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় এমন কথা। শনিবার (১৭ মে) এটি প্রকাশ করা হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত সংবাদের বিরাট একটি অংশ জুড়ে ছিল নিজেদের সামরিক বাহিনীর বন্দনা। ভারতের হামলায় প্রতিবেশী পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক ঘাঁটিতে আঘাত করার পাশাপাশি দুইটি পাক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে— এমন দাবিও করা হয়।
পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম বন্দরনগরী ও দেশটির বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র করাচি বন্দরের একটি অংশ ধ্বংস করা হয়েছে বলেও খবর ছড়িয়ে পড়ে।
সার্বিকভাবে এই তথ্যগুলো পরিবেশনের সময় ভারতীয় মিডিয়া বেশ সুনির্দিষ্ট আঙ্গিকে প্রচার করে, যেন এটি আসলেই ঘটেছে। তবে এগুলোর কোনোটিই সত্য ছিল না।
ভারত ও পাকিস্তানের তীব্র সামরিক সংঘর্ষের সময় এবং তার পরের দিনগুলিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সীমান্তের উভয় পাশেই মিথ্যা, অর্ধসত্য, মিম, বিভ্রান্তিকর ভিডিও ফুটেজ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ব্যবহৃত বক্তৃতার কারণে একপর্যায়ে মিথ্যা থেকে সত্য আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এদিকে, সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন ইস্যুতে পাকিস্তানে সৃষ্ট বন্যার কিছু অংশ ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম প্রচার করে। তবে সংবাদমাধ্যমগুলোর পরিবেশন প্রক্রিয়া ছিল অন্যরকম। সেসময় উপস্থাপকের ভূমিকা অনেকটা এমন হয়ে ওঠে, যেন তারা দুটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের খেলায় চিয়ারলিডার।
একপর্যায়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক ঘাঁটিতে কথিত হামলার খবর প্রকাশ করে। এর পাশাপাশি বলা হয়, সৃষ্ট এ হামলার ফলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে, যা আসলে সত্য ছিল না। এমনকি কোথায় কোথায় হামলা চালানো হয়েছে সেই অঞ্চলগুলো বোঝার সুবিধার্থে তারা মানচিত্রে কিছু এলাকাকে নির্দেশ করে। তবে এই দাবির পক্ষে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভারতীয় নৌবাহিনীর করাচি আক্রমণের খবরটিও একই রকম ছিল, যা ফ্যাক্ট চেকে ধরা পড়ে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভুল তথ্য নিয়ে গবেষণা করা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সুমিত্রা বদ্রীনাথন বলেন, আমরা যখন ভুল তথ্যের কথা ভাবি, তখন আমাদের মনে আসে বেনামী লোকদের কথা, অনলাইন বটের কথা, যেখানে আপনি কখনই জানেন না যে জিনিসটির উৎস কী।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সংঘর্ষের সময় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোও ভুল তথ্যে ভরপুর ছিল। এর রেশ টেনে সুমিত্রা বদ্রীনাথন আরও বলেন, পূর্বে বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিকদের পাশাপাশি প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো সরাসরি বানোয়াট গল্প প্রচার করত। কিন্তু যখন বিশ্বস্ত সূত্রগুলো ভুল তথ্যের মাধ্যম হয়ে ওঠে, তখন সত্যিই এটি একটি বড় সমস্যা। ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত সম্পর্কে দেশটির মূলধারার গণমাধ্যমে ভুল তথ্য শেয়ার, দেশটির এক সময়ের প্রাণবন্ত সাংবাদিকতায় সর্বশেষ আঘাত।
সশস্ত্র সংঘাত যতদিন ধরে চলছে, যুদ্ধরত পক্ষগুলো মিথ্যা এবং অপপ্রচার ছড়িয়েছে। এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলি তাদের দেশের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রচেষ্টাকে অনুকূলভাবে উপস্থাপন করে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়াও ভুল তথ্যের ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে বাকস্বাধীনতার ক্রমাগত অবক্ষয় ঘটেছে। সরকারের সুনামের ক্ষতি করে এমন সংবাদ দমন করার জন্য অনেক সংবাদমাধ্যমকে চাপ দেয়া হয়েছে। অনেক বড় টেলিভিশন নেটওয়ার্কসহ অন্যান্যরা সরকারের নীতি প্রচার করতে শুরু করেছে।
ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং ইন্ডিয়া টুডে টেলিভিশন চ্যানেলের উপস্থাপক রাজদীপ সরদেশাই গত সপ্তাহে পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করার খবর প্রচারের জন্য দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তার উপস্থাপন করা তথ্যটি ‘প্রমাণিত হয়নি’।
কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিলভারম্যান বলেন, ভুল তথ্য কিংবা বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে ছড়ানো তথ্য, এগুলো প্ররোচিত করার জন্য খুবই কার্যকরী। তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে, দুই দেশের ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে দর্শকরা যেকোনো চমকপ্রদ মিথ্যাকে গ্রহণ করতে এবং ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে।
ভারতের একটি ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট ‘এএলটি নিউজ’ যেটি দেশটির মূলধারার দুটি সংবাদমাধ্যম আজ তক এবং নিউজ এইটটিন-এর সম্প্রচারিত অসংখ্য বানোয়াট তথ্যের প্রমাণ সরবরাহ করেছে। ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা প্রতীক সিনহা বলেন, তথ্য বাস্তুতন্ত্র মূলত ভেঙে পড়েছে।
রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্সের মতে, প্রায় ৪৫০টি বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন রয়েছে দেশটিতে। এখনও টেলিভিশন ভারতের জনসাধারণের কাছে তথ্য পৌঁছানোর একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত। তাই এখানে অপতথ্য বা মিথ্যা তথ্যের রেশ অনেক বড় পরিসরে বর্তায়।
গত সপ্তাহে, ভারতের স্বনামধন্য কয়েকটি টেলিভিশন স্টেশন করাচিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর আক্রমণের গল্প প্রচার করে। প্রতিবেদনগুলি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এমনটি এক্সে (সাবেক টুইটার) ‘করাচি’ এবং ‘করাচি বন্দর’ শব্দগুলো রীতিমতো ট্রেন্ডিংয়ে পরিণত হয়। করাচি- শব্দ ব্যবহার করে এমন কিছু ছবি ও ভিডিও সেখানে যুক্ত করা হয় যা দেখে দর্শকদের মনে হতে পারে শহর ও বন্দরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে, ফ্যাক্ট চেকাররা জানতে পারে ওই দৃশ্যগুলি ফিলিস্তিনের গাজার।
সবশেষে, ভারতীয় নৌবাহিনী ব্রিফিংয়ে বলে, তারা করাচিতে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল, তবে তা করেনি।