করোনা মহামারির মধ্যে দেশের অধিকাংশ মানুষ নানা সঙ্কট মোকাবেলা করলেও গত তিন মাসে কোটোপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ৪০০ জন। বর্তমানে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৯৩ হাজার ৮৯০। তিনমাস আগে এ সংখ্যা ছিলো ৮৭ হাজার ৪৯০ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
মহামারি করোনার মধ্যে অধিকাংশ মানুষ যখন সঙ্কটে; তখন কেন বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। জানার চেষ্টা করেছে সাননিউজ। বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা বেশ উদ্বিগ্ন। তাদের পর্যবেক্ষণ- করোনার মধ্যেও এতো সংখ্যক কোটিপতি বাড়া ইঙ্গিত দিচ্ছে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। অর্থাৎ ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবেরা হচ্ছে আরও গরিব।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানে টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না। আর টাকা বিনিয়োগ না হওয়া মানে নতন কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। যখন নতুন কর্মসংস্থান হওয়া বন্ধ হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সমাজে বৈষম্য বাড়ে।
এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা- ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৯৩ হাজার হলেও বাস্তবে কোটিপতির সংখ্যা আরও বেশি।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এরজন্য সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। এ সময়ে কোটিপতি বাড়ার অর্থ হলো দেশের সম্পদশালী লোকদের সম্পদ কমেনি বরং বেড়েছে। একই সাথে তাদের ব্যয়ও কমেছে।
তিনি আরও বলেন, সম্পদশালীরা আগে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণে যেত, অনেক পার্টির আয়োজন করতো এসব এখন পরিস্থিতির কারণে বন্ধ রয়েছে তাই খরচ কমেছে। এছাড়া তারা আপদকালীন সময়ের জন্য ব্যাংকে টাকা রাখছেন। যেন কোনো সমস্যা হলে খরচ করতে পারেন। পাশাপাশি মহামারির কারণে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন। এসব কারণে কোটি টাকার আমানত বেড়েছে।
সাধারণ মানুষের ধারনাও অনেকটা এমন। তারা বলছেন, গত একবছরে অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে ব্যাংকে টাকা রেখেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালমান শাকিল বলেন, যাদের অনেক টাকা আছে তারা স্বাভাবিক সময়ে ব্যবসায় বিনিয়োগের চিন্তা করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায় বিনিয়োগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সে টাকা ব্যাংকে রাখছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিম বলেন, এটাতো স্পষ্টতো বৈষম্য। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। গত কয়েকবছরইতো এমন সংবাদই পাচ্ছি। বিশেষ করে করোনা শুরুর পর থেকে ধনীরা আরও বেশি ধনী হচ্ছে। আর গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারী হিসাবের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি। এর মধ্যে কোটি টাকার উপরে রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। এ সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৩ দশমিক ১৬ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে।
ব্যাংকে কোটি টাকার উপরে রয়েছে- এমন হিসাবধারী গ্রাহকের আমানতের মোট পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ৪৯০। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৬ হাজার ৪০০টি। সেপ্টেম্বরে মোট আমানত জমা ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতি হিসাব ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯টি। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারী হিসাব বেড়েছে ১০ হাজার ৫১টি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারী হিসাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৩ হাজার ৮৭৫টি। পাঁচ কোটি এক টাকা থেকে ১০ কোটির মধ্যে ১০ হাজার ৪৭২, ১০ কোটি এক টাকা থেকে ১৫ কোটির মধ্যে তিন হাজার ৫০৭, ১৫ কোটি এক টাকা থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৬৩২, ২০ কোটি এক টাকা থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ১৩৩, ২৫ কোটি এক টাকা থেকে ৩০ কোটির মধ্যে ৭২৫, ৩০ কোটি এক টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৪ এবং ৩৫ কোটি এক টাকা থেকে ৪০ কোটি টাকার মধ্যে ২৯৪টি আমানতকারী হিসাব রয়েছে।
৪০ কোটি এক টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকার মধ্যে অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৪৭৮টি। আলোচিত সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ৩৯০টিতে দাঁড়িয়েছে, ২০১৯ সালে যা ছিল এক হাজার ২৮৩টি। অর্থাৎ এক বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ১০৭টি।