লকডাউন ঘোষণার পর বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ক্রেতারা। যার প্রভাবে বাজারে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বেড়েছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। শনিবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মিরপুর-২, কচুক্ষেত ও হাতিরপুল বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিনে এসব বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লকডাউন ঘোষণার কিছুক্ষণ পর থেকেই পুরো কারওয়ান বাজার লোকে-লোকারণ্য। একইচিত্র দেখা গেছে সুপার শপগুলোতেও। প্রত্যেক ক্রেতাকেই তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য কিনতে দেখা গেছে। এমন অনেক পরিবার আছেন, যাদের প্রতি মাসে পাঁচ কেজি পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়, তবে লকডাউনের ঘোষণায় তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৫-১০ কেজি পেঁয়াজ কিনতে দেখা গেছে৷ একই চিত্র দেখা গেছে ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, আটা ও মুরগির ক্ষেত্রে। বাজারের প্রতিটি দোকানের সামনে জটলা পাকিয়ে আছেন ক্রেতারা। যাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কেনার কারণে কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যে ৭-১০ টাকা বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট কমায় শনিবার সকালে কমেছিল খোলা সয়াবিন তেলের দাম। সকালে প্রতি কেজি খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি হয়েছে ১২৪ থেকে ১২৬ টাকায়। যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১২৮ থেকে ১৩০ টাকায়। দুপুর থেকে ক্রেতাদের চাপ বাড়ায় আবার ১৩০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। প্রতি লিটার পামওয়েল গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। সকালে বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকায়। দাম বেড়ে দুপুরে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। তবে বোতলজাত তেলের দাম একেক দোকানে একেক রকম দেখা গেছে। প্রতি ৫ লিটার বোতলজাত তেল সকালে ৬৪০ টাকায় বিক্রি হলেও দুপুরে সেই একই তেল বিক্রি হয়েছে ৬৫০ থেকে ৬৬০ টাকায়।
বাজারে পর্যাপ্ত দেশি পেঁয়াজের মজুদ থাকলেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাজারে পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা। সকালে বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৭ টাকায়। সেই একই পেঁয়াজ বেলা গড়াতেই লকডাউনের ঘোষণার পর বিক্রি হয়েছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়। আলুর দাম কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকায়। প্রতি কেজি আদা কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। সকালে যে আদা বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় তা বিকেলে বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ টাকায়। প্রতি কেজি রসুনে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়।
একইচিত্র দেখা গেছে মুরগির বাজারে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকায়। পাকিস্তানি কর্ক মুরগি বিক্রি করতে দেখা গেছে ৩৪০ থেকে ৩৬০ টাকায়। অন্যদিকে দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকায়। যা গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি। বাজারে প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকায়। নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৭২ টাকা, মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়, পাইজম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকায়।
এছাড়া রমজান-কেন্দ্রিক পণ্য ছোলা ৭০ থেকে ৭২ টাকায়, আমদানি করা মসুর ডাল ৮০ থেকে ৯০ টাকায়, দেশি মশুর ডাল ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়, মটর ডাল ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়, আখেরগুড় মানভেদে ৮০ থেকে ১৪০ টাকা, চিড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকায়, হাতেভাজা মুড়ি প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়, প্যাকেটজাত মুড়ি হাফ কেজি ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আসলামুল আজাদ নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী যার পরিবারে প্রতি মাসে পেঁয়াজের প্রয়োজন হয় ৫ কেজি। রোজার সময় ১০ কেজি পেঁয়াজ লাগে বলেও তিনি জানান। তবে আজ তিনি বাজার থেকে ২০ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন। বাড়তি ১০ কেজি পেঁয়াজ কেনার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনিতে আমার পরিবারে ৫ কেজি পেঁয়াজ লাগে। কিন্তু রোজা ও লকডাউনের কারণে ২০ কেজি কিনেছি। লকডাউনের সময় বাজারে দাম আরও বাড়তে পারে। তাই এখনই কিনে নিলাম।
একই অবস্থা দেখা গেছে বাজার করতে আসা অন্যান্য ক্রেতাদেরও। আজিজুর রহমান নামে একজন ৫ কেজি আদা, ২০ কেজি পেঁয়াজ, ২০ কেজি আলু নিয়ে বের হচ্ছেন কারওয়ান বাজার থেকে। তার পরিবারে প্রতি মাসে কত কেজি আদার প্রয়োজন হয় জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, আমি ফ্রিজে প্রসেস করে আদা রেখে দেবো। অনেকদিন পর বাজারে এলাম। তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই বলেন, এটা আমার দোকানের জন্য।
বাজারে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বাড়ার বিষয়ে কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা আলী আহম্মদ বলেন, লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই বাজারে অনেক ক্রেতা আসতে শুরু করছে। যার ৫ কেজি লাগে সে ২০ কেজি নিচ্ছে। প্রয়োজনের বেশি পেঁয়াজ কেনায় বাজারে ঘাটতি পড়ছে। যার কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকানি আলাউদ্দিন বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় পণ্য কম। হঠাৎ লকডাউন ঘোষণার প্রভাবে বাজারে অনেক ক্রেতা আসতে শুরু করেছে। প্রতিটি ক্রেতাই বেশি বেশি পণ্য ক্রয় করছেন। যে কারণে নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের টিম পাঠিয়েছি বাজারে। তবে লকডাউন ঘোষণার ফলে বাজারে বেশি ক্রেতার উপস্থিতির কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। তবে ভোক্তাদের প্রতি অনুরোধ আপনারা প্রয়োজনের বেশি পণ্য মজুদ করার চেষ্টা করবেন না। এসময় বাজারে সব রকম নিত্যপণ্যের যথেষ্ট মজুদ আছে।
এর আগে সকালে এক ব্রিফিংয়ে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আগামী সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে এক সপ্তাহের জন্য সারাদেশে লকডাউন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।