‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল’ করে সহিংসতায় জড়িত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিচারের দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে। শনিবার (৩ এপ্রিল) ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সংসদে এ দাবি তোলেন।
অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত ইসলামবিরোধী। নামে হেফাজতে ইসলাম হলেও তারা ইসলামবিরোধী, জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী। এরা দেশের শত্রু, রাষ্ট্রের শত্রু। এদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। দরকার হলে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে অবিলম্বে তাদের বিচার করতে হবে।
এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য ২০১৩ সালের ৫ মে এর ঘটনায় হেফাজত ইসলামের ‘জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছিল, তার দ্রুত তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
শেখ সেলিম বলেন, কোনো বিএনপি-জামায়াত অপশক্তি যেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করতে না পারে আল্লাহর কাছে সেই দোয়া করি। জন্মশতবার্ষিকী আর সুবর্ণ জয়ন্তীর জন্য অনেক কিছু আমরা সহ্য করে গেছি। আর কোনো কিছু সহ্য করা হবে না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আরো কঠোর হতে হবে। আপনার পেছনে ১৪ কোটি মানুষ আছে। এই অপশক্তিকে ছাড় দেয়া যাবে না।
তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। ইসলাম ধ্বংস করে না। ইসলাম সৃষ্টি করে। হেফাজতের নামে যারা জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। বিএনপি-জামায়াত যাদের সহযোগী হিসেবে.. যারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে। ইসলামের হেফাজত কোনো সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা করতে পারে না। ইসলাম হেফাজত করবে আল্লাহ।
যারা বাংলাদেশকে স্বীকার করে না তাদের বাংলাদেশে থাকার কোনো অধিকার নেই উল্লেখ করে শেখ সেলিম বলেন, যারা বিশ্ববাসীর কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। দেশের অর্জন ও স্বাধীনতার গৌরবকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দরকার হলে ট্রাইব্যুনাল করে অবিলম্বে তাদের বিচার করতে হবে। হেফাজতের জঙ্গিরা যেসব মাদরাসা থেকে রাস্তায় বের হয়ে মানুষ হত্যা করে। মানুষের বাড়িঘর ও স্থাপনায় আক্রমণ করে ও পুড়িয়ে দেয়। সেইসব মাদরাসাও বন্ধ করে দিতে হবে। ইসলাম কখনও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিতে পারে না।
তিনি বলেন, সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১০ দিনের যে অনুষ্ঠান করেছে, তাতে ২৭টি দেশের প্রধান ও ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান ভিডিওবার্তা পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এই অনুষ্ঠান ও ভিতিরবার্তায় বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
একাত্তরের পরাজিত শক্তি, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি; সেই শক্তি আমাদের সুন্দর অনুষ্ঠানকে কলঙ্কিত করতে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতা ঘটিয়েছে অভিযোগ তুলে শেখ সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিএনপি-জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী হেফাজতে ইসলাম হাটহাজারীতে তাণ্ডব চালায়। তারা থানা আক্রমণ করে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। তারা ১০ জন পুলিশকে বোমা মেরে আহত করে। পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ভূমি অফিস ও বিভিন্ন স্থাপনাও পুড়িয়ে দেয়।
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস রয়েছে, তারা কোনোদিন এই জঘণ্য কাজ করতে পারে না। তাদের এই বাংলাদেশে থাকারও কোনো অধিকার নেই। তারা ২৭ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন ও রেললাইনে আগুন দেয়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীত একাডেমি, এসপি অফিস ও থানায় আগুন দেয়। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল পর্যন্ত তারা ভাঙচুর করে এবং আগুন দেয়ার চেষ্টা করে। তারা জেলার প্রেসক্লাবে আগুন দেয়। প্রেসক্লাব সভাপতি রিয়াজউদ্দিন জামিলসহ ১১ জন সাংবাদিককে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন শোভনের বাড়িতে আগুন দেয় এবং পবিত্র কোরআন শরীফ পুড়িয়ে ফেলেছে।
এছাড়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, বায়তুল মোকাররম, বসুন্ধরা এবং ৩০০ ফিট রাস্তার বিভিন্ন স্থানের স্থাপনায় আগুন দেয় ও গাড়ি ভাঙচুর করে বলে উল্লেখ করেন শেখ সেলিম।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের প্রসঙ্গে টেনে শেখ সেলিম বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে বিভিন্ন স্থানে বিনাকারণে কী তাণ্ডব তারা করেছিল। সেদিন খালেদা জিয়া বিএনপিকে হেফাজতের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা বায়তুল মোকাররমে মসজিদে আক্রমণ করে। কোরআন শরীফ পুড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আওয়ামী লীগ অফিসে আক্রমণ করে। এদের কোনো ছাড় দেয়া যেতে পারে না।
সংসদে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার একটি ছবি দেখিয়ে শেখ সেলিম বলেন, এই জঙ্গিরা তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ার ওপর উঠে পেছনে শত শত জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা এবং সরকারি স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য তাণ্ডব চালিয়েছে। ছবি দেখে মনে হচ্ছে প্রাচীনকালের মতো কোনো যুদ্ধে যাচ্ছে।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এমপি সেলিম বলেন, তাদের (হেফাজত নেতাকর্মী) মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশ তালেবান রাষ্ট্র নয়। এটা পাকিস্তান নয়। সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের বাংলার মাটিতে কোনো স্থান নেই। সরকারকে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাধীন দেশে এভাবে চলতে পারে না।
বিএনপির স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর কর্মসূচি বন্ধ করার প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, কারা এ ধরনের কর্মসূচি বন্ধ করে? যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তারা স্বাধীনতার কর্মসূচি বন্ধ করতে পারে না। বিএনপি-জামাত-হেফাজত এরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বিএনপি ২৬ মার্চ স্মৃতিসৌধেও যাইনি। কারণ তারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।
বিএনপির সংসদ সদস্যদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, বিএনপির নেতারা এখানে আছেন। তাদের বাপ-দাদার হিসাব নেয়া হোক। একাত্তরে তারা কোন দলে ছিল। শান্তিবাহিনীতে কারা ছিল। এর অনেক হিসাব আছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আছেন, উনাকে বলব- এগুলো বের করে জনসম্মুখে প্রকাশ করার ব্যবস্থ করেন।
শেখ সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে জিয়াউর রহমান। একাত্তরের পরাজিত জিয়া মোশতাক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের ৫০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে বঙ্গব্ন্ধু কন্যা যখন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসছে, সেই অপশক্তি এই জঘণ্য কাজ শুরু করেছে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি সরকার পতনের নামে এখন বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তারা সহ্য করতে পারে না। বিএনপির নেতা মিজানুর রহমান মিনু প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির বিভিন্ন মসুলিম দেশের সফরের প্রসঙ্গ টেনে সরকার দলের সিনিয়র এই সংসদ সদস্য বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন মুসলিম দেশে সফর করেছেন। সেই সব দেশের সরকার ও জনগণ তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। সেখানে কেউ কোনো টু শব্দ করেনি। আর বাংলাদেশে মোদি এলে মুসলমানদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার আসা নিয়ে এ ধরনের জঘণ্য রাজনীতি। এখানে বাধা দেয়া হয়। এরা পাকিস্তানের নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও তালেবানের অনুসারী। এরা স্লোগান দেয় আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ সেলিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও দেশটির সব রাজনৈতিক দল সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন দিয়েছে। অস্ত্র দিয়ে তারা সাহায্য করেছে। ভারত আমাদের দুর্দিনের বন্ধু। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসতে পারবে না, এটা কোন ধরনের তামাশা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোনো ব্যক্তি নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। যারা মোদিকে আসার বিরোধীতা করে তারা দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারিনি। তারা ইয়াহিয়া, টিক্কা, নিয়াজীর বংশধর। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী। এখনও পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে।
হেফাজতের সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে বক্তৃতা করায় বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে প্রতিবাদ শুরু করলে শেখ সেলিম বলেন, ব্যস্ত হয়েন না। আমি শেষ করি। একটাও উত্তর দিতে পারবেন না। আমি কোনো অসত্য কথা বলিনি।