spot_img

যে কারণে সিরিয়াকে চিরশত্রু মনে করে ইসরাইল!

অবশ্যই পরুন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইউরোপ থেকে বিতাড়িত যেসব ইহুদিকে আরবরা করুণা করে আশ্রয় দিয়েছিলেন, একসময় তারাই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইহুদিদের জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল এসব কুখ্যাত ইসরাইলি চরদের। এদের মধ্যে অন্যতম এলি কোহেন। কুখ্যাত এই ইহুদি গুপ্তচরকে দামেস্ক স্কয়ারে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। আর এ কারণেই সিরিয়াকে চিরশত্রু মনে করে ইসরাইল।

মিসরে শরণার্থী হিসেবে এসেছিল অনেক ইহুদি পরিবার। তেমনি একটি উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান এলি কোহেন আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সিরিয়ার সব গোপন তথ্য পাচার করে ইহুদিদের কাছে। সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখলে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে এলি কোহেনের সংগৃহীত গোপন তথ্যাবলি।

এলি কোহেন- যিনি ছিলেন একজন ইসরায়েলি গুপ্তচর। তাকে ইসরায়েলের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার নামে নামকরণ করা হয় ইসরায়েলের রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।

সিরিয়াতে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কোহেন সমধিক পরিচিত, যেখানে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও সামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু সিরিয়ার কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অবশেষে তার গোয়েন্দা কার্যক্রম উন্মোচিত করে এবং তাকে গ্রেপ্তার করে দোষী সাব্যস্ত করার মাধ্যমে সামরিক আইনে ১৯৬৫ সালে তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করে। ধারণা করা হয়, গ্রেপ্তারের আগে কোহেনের জোগাড় করা গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যগুলো ইসরায়েলকে ছয় দিনের যুদ্ধে সাফল্য এনে দিয়েছিল।

প্রারম্ভিক জীবন
১৯২৪ সালে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এক ধর্মপ্রাণ জায়নবাদী ইহুদি পরিবারে এলি কোহেনের জন্ম হয়। তার পিতা ১৯১৪ সালে সিরিয়ার আলেপ্পো শহর ছেড়ে মিশরে এসেছিলেন। এলি কোহেন ১৯৪৭ সালের দিকে মিশরের সেনাবাহিনীতে দাপ্তরিক কাজে যোগ দেন, কিন্তু আনুগত্যের প্রশ্নে সন্দেহভাজন মনে হওয়ায় সেনাবাহিনীতে অযোগ্য বলে বিবেচিত হন। ইহুদি হওয়ার কারণে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়ে কোহেন পরের বছর ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে নিজ ঘরে অধ্যয়নের সিদ্ধান্ত নেন।

সেই বছরই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর অনেক ইহুদি পরিবার মিশর ছেড়ে দেশান্তরিত হয়ে ইসরায়েলে যেতে শুরু করে। কোহেনের পিতা-মাতাও ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলে পাড়ি জমায়। কিন্তু ইলেকট্রনিক্সের ওপর ডিগ্রি শেষ না হওয়ায় এবং মিশরের ইহুদিদের সাহায্য ও জায়নবাদী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোহেন মিশরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর দু বছর পর ১৯৫১ সালে মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশে জায়নবাদ-বিরোধী অভিযান শুরু হলে এলি কোহেন গ্রেপ্তার হন এবং তার জায়নবাদী কার্যক্রমের জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করা হয়। ১৯৫০-এর দিকে মিশরে থাকাকালীন এলি কোহেন মোসাদের গোপন অভিযানে জড়িত ছিলেন, যে অভিযানের উদ্দেশ্য অত্যাচারের শিকার সংখ্যালঘু মিশরীয় ইহুদিদের মিশর থেকে বের করে ইসরায়েলে স্থানান্তর। দোষী সাব্যস্ত করলেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ মোসাদের এই গোপন অভিযানে কোহেনের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে আটক মিশরীয় যোদ্ধারা
এছাড়া, মিশরের সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ করার জন্য মোসাদ মিশরীয়-ইহুদিদের ব্যবহার করে ১৯৫৪ সালে যে আত্মঘাতী সুসান অভিযান পরিচালনা করে, সেখানেও কোহেনের নাম জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। যদিও এক্ষেত্রেও মিশরীয় কর্তৃপক্ষ অভিযানে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের সাথে কোহেনের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ উদ্ধার করতে পারেনি।

পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকট নামক দ্বিতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মিশরের সরকার ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং অনেক ইহুদির নাগরিকত্ব বাতিল করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে। সেইসময় এলি কোহেনকেও মিশর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সেইসময় ইহুদি সংস্থার সহায়তায় ইতালির নেপলস শহর দিয়ে হাইফা বন্দর দিয়ে কোহেন অবশেষে ইসরায়েলে ঢোকেন। ১৯৫৭ সালে কর্মস্থল হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তিনি যোগ দেন এবং ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা শাখায় কাউন্টার-ইন্ট্যালিজেন্স অ্যানালিস্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

অল্প কিছুদিন পর এই কাজে আগ্রহ হারিয়ে কোহেন বরং মোসাদে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু মোসাদ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশ কোহেন সামরিক বাহিনী থেকেও ইস্তফা নেন। পরের দু বছর তেল আবিবের একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কেরানী হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৫৯ সালে কোহেন উদারপন্থী লেখক সামি মাইকেলের বোন নাদিয়া মাজাল্ডকে বিয়ে করেন। নাদিয়ার সাথে এলি কোহেনের সোফি, ইরিত ও শাই নামের তিন সন্তান।

মোসাদে যোগদান
তৎকালীন মোসাদ প্রধান মেইর আমিত বিশেষ কাউকে খুঁজছিলেন, যিনি সিরিয়ার সরকারি কাজে গুপ্তপ্রবেশ করে সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য মোসাদকে জোগাড় করে দেবেন। এই গোপন গোয়েন্দা অভিযানের জন্য বাহিনীর কাউকে উপযুক্ত মনে না হওয়ায় মেইর আমিত পুরনো ফাইল ঘেঁটে বাতিল হওয়া মোসাদে চাকরিপ্রার্থীদের প্রোফাইল দেখতে শুরু করেন। খুঁজে পান এলি কোহেনকে। তবে এই বিশেষ অভিযানের জন্য কোহেন আসলেই উপযুক্ত কিনা তা যাচাইয়ে প্রায় দু সপ্তাহ তাকে নজরদারি এবং প্রাক-প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়ে যেতে হয়। সবকিছু ঠিক মনে হওয়ার পর কোহেনকে জানানো হয় তিনি এই অভিযানের জন্য উপযুক্ত এবং তাকে পরবর্তী ছয় মাস মোসাদের নিজস্ব ট্রেনিং স্কুলে যেতে হবে। ট্রেনিং শেষে স্নাতক রিপোর্ট তাকে ‘কাৎসা’ বা ‘ফিল্ড এজেন্ট’ হওয়ার জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত বলে বিবেচিত করে।

প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর গোপন মিশনের জন্য ‘আর্জেন্টিনা ফেরত প্রবাসী সিরিয়ান ব্যবসায়ী’ হিসেবে তাকে একটি ভুয়া পরিচয় দেওয়া হয়। এমনকি এই ভুয়া ব্যবসায়ী পরিচয়টিকে নিখুঁত বানানোর জন্য ১৯৬১ সালে তাকে আর্জেন্টিনায়ও পাঠানো হয়।

সিরিয়ার দামেস্কে সফর, অনুপ্রবেশ ও আস্থা তৈরি
কোহেন ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘কামেল আমিন থাবেত’ ছদ্মনামে সিরিয়ার দামেস্কে স্থানান্তরিত হন। কিভাবে কোন কৌশলে কোহেন সিরিয়ার উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ, সেনাকর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং স্থানীয় কূটনীতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলবেন, সেসবের সার্বিক রূপরেখা তৈরি করে দেয় মোসাদ।

আর্জেন্টিনার বিভিন্ন ক্যাফেতে রাজনৈতিক গল্প শোনার মাধ্যমে কোহেন নিজের সামাজিক জীবন অব্যাহত রাখতেন। নিজ ফ্ল্যাটে প্রায়সময় পার্টি আয়োজন করতেন। উচ্চপদস্থ সিরিয়ান মন্ত্রী, ব্যবসায়ী এবং সিরিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মূলত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুন্দরী নারী, বিমানবালা এবং উদীয়মান সংগীত তারকাদের নিয়ে সময় কাটাতে কোহেনের ফ্ল্যাটে যেতেন। এই ধরনের পার্টিতে সিরীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রায়ই তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড ও সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে অবাধে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। এলি কোহেন সেই সমস্ত বৈঠকে মাতাল সেজে আলোচনার সবটাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের ঋণও দিতেন কোহেন। ফলে ক্রমশ বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠা কোহেনের কাছ থেকে রাজনৈতিক পরামর্শও চাইতে শুরু করেন সিরিয়ান কর্মকর্তারা। নারী সংক্রান্ত ব্যাপারেও কোহেন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সিরিয়াতে তিনি প্রায় ১৭ জন নারীর সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন-যাদের বেশিরভাগই সমৃদ্ধশালী পরিবার থেকে উঠে আসা। ধারণা করা হয়, তৎকালীন সিরিয়ার প্রভাবশালী সেনাকর্মকর্তা ও বাথ পার্টির সদস্য আমিন আল-হাফিজের সাথেও কোহেনের সুসম্পর্ক ছিল।

যদিও ২০০১ সালে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমিন আল-হাফিজ কোহেনের সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারটি অস্বীকার করেন। স্বপক্ষ যুক্তি হিসাবে হাফিজ বলেন, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি মস্কোতে ছিলেন। তাই কোহেনের সাথে তার এই ধরনের সম্পর্কের প্রসঙ্গ পুরোপুরি অবান্তর। বলা হয়ে থাকে, হাফিজের শাসনামলে কোহেনকে এমনকি সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বানানোরও কথা ছিল।

গোপন তথ্য সংগ্রহ
১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৫- এই চার বছরে কোহেন ব্যাপক পরিসরে গোয়েন্দা তথ্য ইসরায়েলে পাচার করেন। রেডিও, সাংকেতিক চিঠি এমনকি গোপনে স্বশরীরে তিনবার ইসরায়েলে গিয়েও তিনি তথ্য সরবরাহ করেছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা-কৃতিত্বগুলোর একটি ছিল গোলান মালভূমিতে সফর। যেখানে কোহেন সিরিয়ান সামরিক দুর্গগুলোকে চিহ্নিত করে সেসব স্থানসমূহের স্পর্শকাতর তথ্য ইসরায়েলে প্রেরণ করেছিলেন। তখন সিরিয়ান সেনাদের প্রতি কপট-সহানুভূতি দেখিয়ে প্রখর রোদে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য কোহেন সেনাদের প্রতিটি অবস্থানে গাছ লাগিয়ে আসেন। এই গাছগুলোই ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলিদের কাছে সিরিয়ান সেনাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়। ইসরায়েলের সেনারা কেবল গাছ লক্ষ্য করেই সিরিয়ান সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। যুদ্ধে মাত্র দুই দিনেই ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এছাড়াও সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে বেশ কয়েকবার সফর করে কোহেন সিরিয়ার সামরিক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে স্পর্শকাতর ছবি ও স্কেচ মোসাদের হাতে তুলে দেন।

প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সুন্দরী নারীদের নিয়ে সময় কাটাতে কোহেনের ফ্ল্যাটে যেতেন
কোহেন- মর্টার আর পরিধি নিয়ে তিনটি লাইন তৈরির ব্যাপারে সিরিয়ানদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পরিকল্পনাও জেনে ফেলেন। অথচ এর আগে ইসরায়েল সেনাবাহিনী শুধু একটি লাইন নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

আসল পরিচয় উন্মোচন ও গ্রেপ্তার
নতুন নিযুক্ত সিরিয়ান গোয়েন্দা উপদেষ্টা কর্নেল আহমেদ সু’এদানি কাউকেই বিশ্বাস করতেন না এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি কামেল আমিন থাবেতকে (কোহেন) অপছন্দ করতেন। এ পর্যায়ে কোহেন তার পরিচয় উন্মোচিত হবার আশঙ্কায় পড়েন। ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে কোহেন যখন তথ্য পাচার করতে এবং নিজের তৃতীয় সন্তানকে দেখতে গোপনে ইসরায়েলে যান, তখন তিনি তার এই উদ্বেগের কথা মোসাদের কাছে প্রকাশ করেন। তা সত্ত্বেও, মোসাদ শেষবারের মতো কোহেনকে সিরিয়ায় যেতে প্ররোচিত করে। সিরিয়ায় যাওয়ার আগে কোহেন তার স্ত্রীকে এই বলে আশ্বস্ত করেন- এটাই সিরিয়ায় তার শেষ সফর, এরপর তিনি পাকাপাকিভাবে ইসরায়েলে ফিরে আসবেন।
১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে সিরিয়ান কর্তৃপক্ষ গোয়েন্দা তথ্যচুরি উদঘাটনে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসে যারা সোভিয়েতের বানানো বিভিন্ন শনাক্তকরণ যন্ত্র ও প্রযুক্তির সাহায্যে সিরিয়া থেকে বাইরে পাঠানো রেডিও সংকেত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। সিগন্যাল ট্রান্সমিশন পর্যবেক্ষণের পর সিরিয়ার বাইরে যাওয়া রেডিও সংকেতের উৎস খুঁজে বের করা হয় এবং ২৪ জানুয়ারি সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী কোহেনের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে রেডিও সংকেত পাঠানো অবস্থায় হাতেনাতে তাকে গ্রেপ্তার করে।

বিচার ও মৃত্যুদণ্ড
সামরিক আইনে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে এলি কোহেন দোষী সাব্যস্ত হন এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রিমান্ডে তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ ও অত্যাচার করা হয়েছিল। কোহেনের প্রতি সহানুভূতি আদায় করে এই বিচার রুখতে ইসরায়েল সেইসময় একটি আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান শুরু করে। কোহেনকে ফাঁসির সিদ্ধান্ত থেকে দামেস্ককে সরিয়ে আনতে ইসরায়েলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন) গোল্ডা মেয়ার এই আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা, প্রধানমন্ত্রীরা এমনকি পোপ পল ষষ্ঠও এই বিচারে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন। গোল্ডা মেয়ার এই বিচারের বিরুদ্ধে মধ্যস্থতা করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছেও আবেদন জানান। নানা আন্তর্জাতিক আবেদন এবং ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও কানাডার প্রতিনিধিদের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সিরিয়ান সরকারকে এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যায়নি।
১৯৬৫ সালের ১৮ মে মাজরেহ স্কয়ারে জনসম্মুখে কোহেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির দিনে কোহেন একজন রাবাইয়ের (ইহুদি পুরোহিত) সাথে সাক্ষাতের শেষ ইচ্ছা পোষণ করেন। ট্রাকে করে মাজরেহ স্কয়ারে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় সিরিয়ার প্রবীণ প্রধান ইহুদি পুরোহিত রাবাই নিসিন আন্দাবো শেষ যাত্রায় তাকে সঙ্গ দেন।

সমাধি ও শবদেহ
১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসে কোহেনের স্ত্রী নাদিয়া তার স্বামী এলি কোহেনের কৃতকার্যের জন্য ক্ষমা চেয়ে সিরিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল-আসাদকে একটি চিঠিতে কোহেনের শবদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। ২০০৭ সালে তুরস্ক একবার মধ্যস্থতার কথা বলে কোহেনের মৃতদেহ সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে হাফেজ আল-আসাদের প্রাক্তন ব্যুরো প্রধান মনসির মাওসিলি জানিয়ে দেন, কোহেনের মৃতদেহ ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়, কেননা কোথায় তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল সেটা এখনো অজানা।
মোসাদ যাতে গোপন মিশনের মাধ্যমে কোহেনের শবদেহ ইসরায়েলে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সিরিয়ানরা অবস্থান পরিবর্তন করে অন্তত তিন জায়গায় কোহেনকে কবর দিয়েছিল।

জাতীয় বীর উপাধি ও পপুলার কালচারে এলি কোহেন
মৃত্যুর পর থেকে কোহেন ইসরায়েলে জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকেন। ইসরায়েলের অনেক রাস্তা এবং এলাকা তার নামে রাখা হয়। ১৯৭৭ সালে কোহেনের পুত্রের বার মিতজাহ (১২ এবং ১৩ বছর বয়সে ইহুদি ছেলে-মেয়েদের জন্য আয়োজিত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন, সেনাবাহিনীর প্রধান মোরদেশাই গুরসহ মোসাদের আরো অনেক কর্মকর্তারা অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। জেরুজালেমের মাউন্ট হার্জেলে নিখোঁজ সৈনিকদের বাগানে এলি কোহেনের স্মৃতির উদ্দেশে একটি স্মারক নির্মিত হয়েছে। সূত্র : জেরুজালেম পোস্ট

সর্বশেষ সংবাদ

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৪৭ ফিলিস্তিনি

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বর্বর হামলায় আরও ৪৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৪৩...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ