ক্ষমতা গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে এশিয়াবিষয়ক নতুন একটি পদ তৈরি করতে যাচ্ছেন জো বাইডেন। এর দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা কার্ট ক্যাম্পবেল। ওবামা প্রশাসনের আমলে কার্ট ক্যাম্পবেল তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময়ও এশিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রায়োগিক দিকগুলো দেখাশোনার কাজটি কার্ট ক্যাম্পবেলই করেছেন। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন বিজয়ী হলে কার্ট ক্যাম্পবেল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নিয়োগ পেতেন বলে ধারণা অনেকের।
আর ছয়দিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন জো বাইডেন। এরই মধ্যে নিজ মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করেছেন তিনি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় হিলারির ঘনিষ্ঠদেরই আধিপত্য দেখা যাচ্ছে বেশি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জেক সুলিভানের কথা। এরই মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেছেন জো বাইডেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়ে হিলারি ক্লিনটনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরও আগে হিলারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে জেক সুলিভান তার ডেপুটি চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে জেক সুলিভান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ২০১২ সালে তাকে এ চুক্তির মিশন দিয়ে গোপনে ওমানে পাঠিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। ওই চুক্তির পেছনে জেক সুলিভানের মতো কার্ট ক্যাম্পবেলেরও বড় ধরনের ভূমিকা ছিল।
হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিনকেনের। তবে এক্ষেত্রে তার চেয়ে তার স্ত্রী ইভান রায়ানের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা তুলনামূলক বেশি। ১৯৯৫ সালে বিল ক্লিনটনের প্রশাসনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে বক্তব্য লেখক হিসেবে কর্মরত ছিলেন অ্যান্থনি ব্লিনকেন। ওই সময়ে ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনের শিডিউলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন ইভান রায়ান। সেখানেই ব্লিনকেন ও রায়ানের মধ্যে পরিচয় হয়। পরবর্তী সময়ে ব্লিনকেন-রায়ান দম্পতির নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানেও হিলারি ক্লিনটনকে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে। হিলারি ক্লিনটন ২০০১ সালে নিউইয়র্ক থেকে মার্কিন সিনেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময়ে তার নির্বাচনী শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ব্লিনকেনের স্ত্রী ইভান রায়ান।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) পরবর্তী পরিচালক হিসেবে উইলিয়াম জোসেফ বার্নসের নাম ঘোষণা করেছেন জো বাইডেন। উইলিয়াম জোসেফ বার্নসও মার্কিন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। বারাক ওবামা প্রশাসনে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন জোসেফ বার্নস। তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও সে সময় তার ওপর অনেকটাই আস্থা ও নির্ভরতা দেখিয়েছেন। বারাক ওবামা বুশ প্রশাসনের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণের সময়ে একদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন জোসেফ বার্নস। জেক সুলিভানের মতো উইলিয়াম বার্নসও ইরানকে পরমাণু চুক্তিতে সই করতে রাজি করানোয় সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। হিলারির ভাষায় উইলিয়াম বার্নসই ছিলেন ওই চুক্তির মূল স্থপতি। এ কারণে হিলারি ক্লিনটন ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হলে উইলিয়াম বার্নসকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের প্রথম পছন্দ ছিলেন মিশেল ফ্লোরনয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করলে তাকেই নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল হিলারির। ২০ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন হতে যাওয়া বাইডেন প্রশাসনেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ নীতির কট্টর সমর্থক মিশেল ফ্লোরনয়ের নামটিই উঠে এসেছিল সবার আগে। তবে তার বদলে দেশটির ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল লয়েড অস্টিনের নাম ঘোষণা করেছেন জো বাইডেন। লয়েড অস্টিনের সঙ্গেও বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে হিলারি ক্লিনটনের। হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ডের প্রধান হিসেবে ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক কার্যক্রমের বিষয়টি লয়েড অস্টিনই দেখভাল করেছেন। তবে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সাবেক এ সেনা কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠতা আরো অনেক আগে থেকেই। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে লয়েড অস্টিনের মনোনয়নের খবরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে হিলারি নিজেই তার সম্পর্কে বলেছেন, তাকে আমি চিনি ১৫ বছর ধরে। সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি আমি। আমি জানি তিনি ইতিহাস গড়বেন। দেশেরও ভালোভাবেই সেবা করবেন।
তবে লয়েড অস্টিনের নাম ঘোষণা হলেও মিশেল ফ্লোরনয়ের ভাগে শিকে ছেঁড়ার সম্ভাবনা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। মার্কিন আইন অনুযায়ী সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের সাত বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এ ধরনের পদের দায়িত্ব পালন করতে হলে তাতে কংগ্রেসের বিশেষ অনুমোদন লাগে। ১৯ জানুয়ারি এ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের একটি শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। শুনানিতে অস্টিন ছাড়পত্র না পেলে কপাল খুলে যেতে পারে ফ্লোরনয়ের।
নিজ প্রশাসনের কৃষিমন্ত্রী হিসেবে টম ভিলস্যাকের নাম ঘোষণা করেছেন জো বাইডেন। হিলারির প্রতি দীর্ঘদিন ধরেই আনুগত্য প্রকাশ করে এসেছেন তিনি। সত্তরের দশক থেকেই হিলারির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা টম ভিলস্যাকের। ২০০৮ সালে হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের জন্য বারাক ওবামার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়ালে তাতে সমর্থন দেন টম ভিলস্যাক। ওই সময় হিলারির প্রচার শিবিরের ন্যাশনাল কো-চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়ে নিজের রানিং মেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী) হিসেবে শর্টলিস্টে দুজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা ছিল—টম ভিলস্যাক ও টিম কেইন। যদিও ওই সময় শেষ পর্যন্ত টিম কেইনকেই বেছে নেয়া হয়।
শর্টলিস্টে না এলেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারির রানিং মেট হিসেবে সম্ভাবনা ছিল জিনা রাইমন্ডোরও। মনোনয়ন না পেলেও হিলারির জাতীয় নির্বাচনী শিবিরের ছয়জন কো-চেয়ারের অন্যতম ছিলেন তিনি। রোড আইল্যান্ডের গভর্নর জিনা রাইমন্ডোকে নিজের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছেন জো বাইডেন। পূর্বসূরি, সাবেক সহকর্মী ও প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে বর্ণনা করেছেন ‘রোড আইল্যান্ডের হিলারি’ হিসেবে।
বাইডেন প্রশাসনের জ্বালানিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন জেনিফার গ্র্যানহম। হিলারি ক্লিনটনের ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই তার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে গিয়েছেন গ্র্যানহম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বারাক ওবামার বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটদের মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়েও হিলারিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন মিশিগান অঙ্গরাজ্যের সাবেক এ গভর্নর। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলাকালেও জেনিফার গ্র্যানহম বিভিন্ন স্থানে ‘সরাসরি হিলারির প্রতিনিধি’ হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছেন।