খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলা এবং ত্রিপুরার দক্ষিণ সাবরুম সীমান্ত এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ফেনী নদীর ওপর নির্মানাধীণ মৈত্রী সেতুর কাজ শেষ পর্যায়ে। ভারতের আগরতলা, ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার, মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন পরিদর্শন করেছেন। এরি মধ্যে সেতুর ৯৮ভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। কাজের দ্রুত অগ্রগতি দেখে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি সেতু নির্মাণ সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন ও নির্মাণ কাজ নকশা মোতাবেক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখেন। গত বুধবার মৈত্রী সেতু পরিদর্শনকালে সহকারি হাইকমিশনারের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
গত শনিবার সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে পণ্য সামগ্রী সরাসরি সড়ক পথে ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আরও গতি আনার জন্য রামগড় উপজেলা ও ত্রিপুরা, জেলার সাবরুম এলাকায় ফেনী নদীর উপর নির্মাণাধীন দুই দেশের মৈত্রী সেতু জোরালো ভুমিকা রাখবে বলে মনে করেন দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ।
আগরতলা ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দুতাবাসের সহকারী হাইকমিশনার, মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন জানান, ভারত সরকারের অর্থায়নে এই মৈত্রী সেতু নির্মাণ হচ্ছে । সাবরুম পর্যন্ত ট্রেন পরিসেবা চালু হয়ে গেছে। মৈত্রী সেতু চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দর এবং মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে সরাসরি ট্রাকে করে কন্টেইনার সাবরুমে চলে আসবে। এরপর সাবরুম স্টেশন থেকে পণ্যবাহী ট্রেন বা বিকল্প পরিবহণে করে উত্তর-পূর্ব ভারতের যে কোন প্রান্তে পণ্যগুলি দ্রুত পরিবহন সহজ হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারত ১ হাজার একর জমিতে বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে তুলবে এবং ভারতের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এতে বিনিয়োগ করবে। ত্রিপুরার দক্ষিণের শহর সাবরুম থেকে চট্টগ্রা সমুদ্র বন্দর সড়ক পথে মাত্র ৭০ কিলোমিটার। মিরসরাই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল মাত্র ৩০ কিলোমিটার। পাশাপাশি এই সেতুটি ব্যবহার করার ফলে ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। ফলে উভয় দেশ অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৩০ হাজার একর জমিতে হচ্ছে এশিয়ার বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর।এখানে আলাদা ভাবে ১ হাজার একরে হচ্ছে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল। প্রতিবেশী দেশটির বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষায়িত এ অঞ্চলে ঋণও মিলবে ভারতীয় তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায়। এ ইজেড উন্নয়নে সাড়ে ১১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করবে দেশটি।
বেজা সূত্রে জানা গেছে, উভয় দেশের সরকারের (জিটুজি) যৌথ উদ্যোগে দেশের বৃহত্তম এ শিল্পনগরে এই ইজেড স্থাপন করা হচ্ছে।
মিরসরাইয়ে ভারতীয় ইজেড উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত প্রকল্প গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশটির বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ অনুযায়ী দুরত্ব এবং যোগাযোগ সুবিধার কারণে মিরসরাইয়ে ইজেড অগ্রধিকার পাচ্ছে। এটির উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় এ ইজেডের সম্পূর্ণ উন্নয়ন করা হবে। ইতোমধ্যে এক হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ করেছে বেজা। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে ঋণের শর্ত অনুযায়ী ইজেড উন্নয়নে ভারত আদানি পোর্ট অ্যান্ড এসইজেডকে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন করে বাংলাদেশকে জানিয়েছে।
বেজার কর্মকর্তারা জানান, মিরসরাইয়ে ইতোমধ্যে এশিয়ান পেইন্টসহ কয়েকটি ভারতীয় কোম্পানি কারখানা নির্মান কাজ শুরু করেছে। এটির কাজ শেষ হলে ভারতীয় বিনিয়োগ আরো বহুগুণ বাড়বে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি ভারতীয় তৃতীয় এলওসির আওতায় ইজেডে অর্থায়নের নীতিগত সম্মতি দিয়েছে দেশটির সরকার। বঙ্গবন্ধু শিল্প শহরে প্রস্তাবিত এ ইজেড উন্নয়নে সম্পূর্ণ অর্থায়ন করছে দেশটি। পরামর্শক নিয়োগ করে ডেভেলপের কাজ শুরু হয়েছে। আনুষঙ্গিক সব প্রক্রিয়া শেষে মাঠ পর্যায়ের উন্নয়নের কাজ চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভারতীয় হাইকমশিনের কর্মকর্তা জানান, তাদের দেশের বেশ কিছু কোম্পানি বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গাড়ি, ওষুধ ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহ তাদের। স্থল বন্দর চালু হলে দুই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে।
দুই দেশের ব্যবসায়ী মহল মনে করছেন সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের পর স্থল বন্দরের কার্যক্রম চালু হলে খুলে যাবে আঞ্চলিক বানিজ্যের নতুন দুয়ার। এই স্থলবন্দর চালু হলে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি কমবে বলেও আশা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় করেরহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, সীমান্তের দ্ইু প্রান্তের পরিবেশ-সংস্কৃতি অনেকটা মিল রয়েছে। দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতির বন্ধন। এই সেতু চালু এবং স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু হলে আশা করি দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।
রামগড় উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী নুরুল আলম আলমগীর বলেন, এই মৈত্রী সেতুর ফলে বিশাল অর্থনৈতিক অগ্রগতি হবে এ অঞ্চলে। যোগাযোগ সুবিধার ফলে এখানে ব্যবসা বানিজ্যের জংশন হবে। গড়ে উঠবে শিল্প কলকারখানা। মৃত অনাবাদি পাহাড়ী জমি জেগে উঠবে। পরিশ্রমী মানুষের জীবনে আসবে সোনালী স্বপ্নের দিন। কর্মসংস্থান হবে একটি বিশাল অংশের। স্থানীয়ভাবে ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে দেশের অর্থনৈতিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন এই অঞ্চলের মানুষ।
এদিকে এই সেতু এবং স্থল বন্দরকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের গেইটওয়ে হিসাবে দেখছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করছেন দুই দেশের অর্থনৈতিক ঘাটতি কমিয়ে আনতে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে স্থলবন্দর এবং মৈত্রী সেতু।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৬ জুন বাংলাদেশের রামগড় এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম সীমান্তে ফেনী নদীর উপর নির্মাণাধীন মৈত্রী সেতুর ফলক উন্মোচন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ৪১২ মিটার দীর্ঘ এবং প্রায় ১৫ মিটার প্রস্থের এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশ।