spot_img

সাংসারিক শান্তির জন্য স্ত্রীর সঙ্গে বোঝাপড়া

অবশ্যই পরুন

ইসলাম পরিবারকে সমাজের মূল ভিত্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে। একটি সুখি পরিবারের চাবিকাঠি হলো স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা শ্রদ্ধা এবং একে অপরের হক আদায় করা। কখনো কখনো পরিবারে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে বা পারিবারিক সংকট তৈরি হতে পারেন। ইসলামে এই সমস্যার সমাধানের জন্য অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত, মনস্তাত্ত্বিক এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে। এখানে উগ্রতা বা কঠোরতার চেয়ে হেকমত ও ধৈর্যের স্থান অনেক উঁচুতে।

সংশোধনের কুরআন নির্দেশিত পদ্ধতি
যখন স্ত্রী কোনো ন্যায়সংগত কারণ ছাড়াই স্বামীর অবাধ্য হয়, ইসলামী পরিভাষায় একে ‘নুশুজ’ বলা হয়। পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা অবাধ্য স্ত্রীকে সংশোধনের জন্য তিনটি ধারাবাহিক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর (মৃদু শাসন)। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করো না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৩৪)

এই আয়াতের আলোকে সংশোধনের ধাপগুলো নিম্নরূপ—
প্রথম ধাপ : সদুপদেশ ও বোঝানো
প্রথমেই রাগারাগি বা কঠোর হওয়া যাবে না। বরং অত্যন্ত ভালোবাসা ও দরদ দিয়ে স্ত্রীকে বোঝাতে হবে। তাকে আল্লাহর ভয় দেখাতে হবে। পরকালের জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। স্বামীর অধিকার এবং অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে হাদিসের বাণীগুলো সুন্দর ভাষায় শোনাতে হবে। নিজের আচরণের দিকেও তাকাতে হবে যে স্বামীর কোনো ভুলের কারণে স্ত্রী এমন করছে কি না। উপহার দিয়ে বা মন জয় করে তাকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা সুন্নাহসম্মত।

দ্বিতীয় ধাপ : বিছানা বা শয্যা পৃথক করা
যদি উপদেশে কাজ না হয়, তবে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে বিছানা আলাদা করে দিতে হবে। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ।
এর অর্থ ঘর থেকে বের করে দেওয়া নয়। বরং একই ঘরে থেকে ঘুমানোর জায়গা বা বিছানা আলাদা করা। অথবা বিছানায় তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে শোয়া, যাতে স্ত্রী বুঝতে পারে যে স্বামী তার আচরণে মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছেন।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসার। যখন স্বামী শারীরিক ঘনিষ্ঠতা বা আদর থেকে বিরত থাকবেন, তখন স্ত্রীর মনে অনুশোচনা জাগবে এবং সে সংশোধিত হবে।

তৃতীয় ধাপ : মৃদু শাসন
যদি উপরের দুটি ধাপ ব্যর্থ হয় এবং স্ত্রী চরম অবাধ্যতা চালিয়ে যায়, তবে ইসলাম চূড়ান্ত পর্যায়ে মৃদু শাসনের অনুমতি দিয়েছে। তবে এর জন্য কঠোর শর্ত আছে—আঘাত যেন চেহারায় না হয়। রাসুল (সা.) চেহারায় আঘাত করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আঘাত এমন হতে হবে, যা শরীরে কোনো দাগ না ফেলে, হাড় না ভাঙে বা রক্তপাত না ঘটায়। তাফসিরে এসেছে, এই আঘাত হবে মেসওয়াক বা রুমালের মতো হালকা বস্তু দিয়ে, যার উদ্দেশ্য ব্যথা দেওয়া নয় বরং নিজের অসন্তুষ্টির তীব্রতা প্রকাশ করা। এটি প্রতিশোধমূলক মারধর নয়, বরং সংশোধনের শেষ চেষ্টা। তবে নবীজি (সা.) জীবনে কখনো কোনো নারীর গায়ে হাত তোলেননি। তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। (জামে তিরমিজি)
তাই মারধরকে পরিহার করাই সর্বোত্তম পন্থা। (মাআরেফুল কোরআন)

চতুর্থ ধাপ : সালিশ বা বিচারক নিয়োগ
যদি উপরের তিনটি ধাপেই কাজ না হয় এবং বিচ্ছেদ ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে আল্লাহ তাআলা সুরা নিসার ৩৫ নম্বর আয়াতে সমাধানের আরেকটি পথ দেখিয়েছেন।
স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন মুরুব্বি বা জ্ঞানী ব্যক্তিকে সালিশ হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। তারা উভয় পক্ষের কথা শুনে মিটমাট করে দেবেন। আল্লাহ বলেন, যদি তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চায়, তবে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে দেবেন।
এসব চেষ্টার ফাঁকে ফাকে স্বামীকে আরো কিছু কাজ করা চাই।

১. আত্ম-সমালোচনা ও নিজের সংশোধন
স্ত্রী অবাধ্য হলে স্বামীর সর্বপ্রথম উচিত নিজের দিকে তাকানো। সালাফদের কেউ কেউ বলতেন, আমি যখন কোনো গুনাহ করতাম, তখন তার প্রভাব আমার স্ত্রী এবং বাহন পশুর আচরণের মধ্যে দেখতে পেতাম। (তারিখে দিমাশক: ৪৮/৩৮৩)
তাই স্বামী চিন্তা করবেন, তিনি আল্লাহর কোনো হক নষ্ট করছেন কি না বা স্ত্রীর প্রতি কোনো জুলুম করছেন কি না। অনেক সময় স্বামীর আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্ত্রী অবাধ্য হন। স্বামী নিজেকে সংশোধন করলে আল্লাহ স্ত্রীর মন ঘুরিয়ে দিতে পারেন।

২. হাদিয়া বা উপহার প্রদান
মানুষের মন জয় করার বড় হাতিয়ার হলো উপহার। কঠোরতার বদলে ভালোবাসার মাধ্যমে অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা একে অপরকে উপহার দাও, এতে পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৯৯৪)
স্ত্রীর পছন্দের কোনো জিনিস উপহার দিয়ে তার মন নরম করে এরপর তাকে বুঝিয়ে বলা। এটি কঠোরতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী।

৩. কারণ অনুসন্ধান ও সহানুভূতি
স্ত্রী কেন অবাধ্য হচ্ছেন, তার মূল কারণ খুঁজে বের করা। তিনি কি অসুস্থ? মানসিকভাবে বিপর্যস্ত? নাকি শ্বশুরবাড়ির অন্য কারো আচরণে কষ্ট পেয়েছেন? রাসুল (সা.) তাঁর স্ত্রীদের মানসিক অবস্থার প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। একবার আয়েশা (রা.)-এর সাথে কথা বলার সময় নবীজি বলেন, আমি জানি তুমি কখন আমার ওপর খুশি থাকো আর কখন রাগ করো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২২৮)

অর্থাৎ, স্ত্রীর মনের খবর রাখা স্বামীর দায়িত্ব। কারণ জানলে সমাধান সহজ হয়।

৪. নীরবতা পালন ও উপেক্ষা করা
তর্কাতর্কির সময় পালটা জবাব না দিয়ে চুপ থাকা বা কিছুদিনের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বন্ধ রাখা। এটি সূরা নিসার বিছানা আলাদা করার আগের ধাপ হতে পারে।
নবীজি (সা.) একবার তাঁর স্ত্রীদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে প্রায় এক মাস তাদের সাথে কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজেকে আলাদা রেখেছিলেন। এই নীরবতা স্ত্রীকে চিন্তার সুযোগ দেয় যে, তিনি ভুল করছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৯১)

সব প্রচেষ্টার পাশাপাশি স্বামীর উচিত আল্লাহর কাছে দোয়া করা। ইবরাহিম (আ.) ও অন্যান্য নবীরাও পরিবারের জন্য দোয়া করেছেন। তাহাজ্জুদের নামাজে বা শেষ রাতে স্ত্রীর হেদায়েত ও ভালোবাসা চেয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা অত্যন্ত কার্যকর।

পরিশেষে বলবো, স্ত্রী কেবল ঘরের মানুষ নন, তিনি স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী ও সন্তানের মা। তাকে সংশোধনের জন্য ইসলাম যে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, তাতে আছে অপার প্রজ্ঞা। হুট করে তালাক দেওয়া বা অমানবিক নির্যাতন করা ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং ধৈর্য, ভালোবাসা, নসিহত এবং প্রয়োজনে সামান্য অভিমান বা শাসনের মাধ্যমে দাম্পত্য কলহ দূর করাই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।

সর্বশেষ সংবাদ

১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসছে বিশ্বকাপের ট্রফি

বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্বকাপ ট্রফি আবারও বাংলাদেশে আসছে। ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আয়োজিত বিশেষ ট্রফি ট্যুরের অংশ...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ