মানব সমাজে ছড়িয়ে থাকা এক ভয়ংকর ব্যাধির নাম হলো, হিংসা। যাকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘হাসাদ’ বলা হয়েছে। সহজে বলতে গেলে হিংসা হলো, অন্যের অর্জনে ব্যথিত হওয়া এবং তার প্রাপ্ত নিয়ামত ও কল্যাণ তার থেকে কোনোভাবে দূর হয়ে যাওয়ার বাসনা পোষণ করা। কিছু হিংসুক তো অন্তরে বাসনা করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং তারা অন্যকে তার প্রাপ্ত বা প্রাপ্য নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করতে রীতিমতো যুদ্ধে নেমে পড়ে। হিংসা মানুষের মাঝে জন্ম দেয়, শত্রুতা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ—এমনকি অন্যের বিপদে পৈশাচিক আনন্দ অনুভবের প্রবণতা।
ইসলামের দৃষ্টিতে হিংসা করা হারাম। কেননা এটি একদিকে যেমন আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরের ফায়সালার ওপর আপত্তি প্রকাশ, অন্যদিকে অন্যের অকল্যাণ কামনা করা। তাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে বা গোপনে ষড়যন্ত্র করা। এ জন্য মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘(আর আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন তারা হিংসা করে।’ (সুরা ফালাক, আয়াত : ৫)
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) তাঁর উম্মতকে এই ধ্বংসাত্মক ব্যাধির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তিনি এই অভ্যাসকে রোগ বলে আখ্যা দিয়েছেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, যুবায়র ইবনে আওয়াম (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মাঝে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ও প্রতারণার রোগ ঢুকে পড়েছে এবং তা দ্বীন কেটে ফেলার খুর—চুল কাটার খুর নয়, (অর্থাৎ তোমাদের এসব অসৎ চরিত্র দ্বীনকে এমনভাবে মূল উৎপাটন করে, যেমন খুর দ্বারা চুল উৎপাটন করা হয়)। যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, সে সত্তার শপথ! তোমরা পরস্পর ভালোবাসা স্থাপন না করা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলে দেব না, যা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে পারবে? তা হলো, তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের বিধান চালু করবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১০৮)
তাছাড়া হিংসা হচ্ছে কাফিরদের স্বভাব। তারা কখনোই চাইত না যে, মুসলমানদের কাছে কোনো কল্যাণ বা নিয়ামত আসুক। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আহলে কিতাব ও মুশরিকদের মধ্য থেকে যারা কুফরি করেছে, তারা চায় না যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর কোনো কল্যাণ নাজিল হোক। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর রহমত দ্বারা খাস করেন এবং আল্লাহ মহান অনুগ্রহের অধিকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১০৫)
অনেকের মতে, আবার হিংসা হলো একটি মানসিক রোগ, যা নিম্ন মানসিকতা ও অন্যের কল্যাণ সহ্য না করার মানসিকতাকে প্রকাশ করে।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ইবনু সিনা বলেছেন—‘হিংসা কৃপণতার থেকেও খারাপ। কারণ কৃপণের শুধু নিজের সম্পদ কাউকে দিতে না চাওয়ার প্রবণতা কাজ করে, কিন্তু হিংসুকের চাওয়া হলো, সে ছাড়া অন্য কেউ যেন কোনো কল্যাণ না পায়—even যদি সেই কল্যাণ তার নিজের সম্পত্তি না হলেও, তার সেখানে আপত্তি থাকে। আর যে ব্যক্তি সেই কল্যাণ পাচ্ছে, সে যদি হিংসুকের কোনো ক্ষতিও না করে, তবুও হিংসুক তা সহ্য করতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন—‘হিংসা আত্মাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি মানুষকে এমন কাজে ব্যস্ত রাখে, যা তার নিজের বা শরীরের কোনো উপকারে আসে না। এর ফলে দীর্ঘশ্বাস, দুঃখ, অযথা চিন্তা, নিদ্রাহীনতা ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস জন্ম নেয়। এতে শরীরের রঙ ম্লান হয়ে যায়, চেহারা বিকৃত হয় এবং স্বভাব দুর্বল হয়ে পড়ে।’ (আল-মাউসুআতুত তিব্বিয়্যাহ আল-ফিকহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৩৬০)