ইহুদি ধর্ম এমন একটি আসমানি বা ঐশী ধর্ম, যার ভিত্তিভূমি গঠিত হয়েছে তাওরাত, তালমুদ এবং ইহুদি পণ্ডিত, মুফতি ও বিচারকদের ফতোয়া ও সিদ্ধান্তের ওপর। যদিও এটি আল্লাহপ্রদত্ত একটি ধর্ম, তবু যুগের পরিবর্তন, বিশ্বায়নের প্রভাব ও ইহুদিদের অতিরিক্ত পার্থিবতাপূর্ণ জীবনাচরণের দরুন এই ধর্ম এত বিপুল পরিমাণে উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গেছে যে এর মূল সত্তা প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ধর্মে এতধিক বিকৃতি ও সংযোজন ঘটেছে যে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ইহুদি ধর্মের প্রাথমিক বিশুদ্ধ রূপ শনাক্ত করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবু বর্তমান কালের প্রেক্ষিতে ইহুদি ধর্মকে বুঝতে হলে ইহুদি ইতিহাস এবং অন্যান্য জাতিসমূহের সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্ক—এই দুইয়ের বিশদ অধ্যয়ন একান্ত অপরিহার্য। ইহুদিদের আহলে কিতাব বা কিতাবধারী বলা হয় এবং তারা নিজেদের ধর্মের সূচনা আব্রাহাম (ইব্রাহিম) আলাইহিস সালাম থেকে করে থাকে।
ইহুদি জাতির প্রকৃত নাম বনি ইসরাঈল। এই নামের পেছনে আছে তাদের পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর অন্য নাম ইসরাঈল। বনি ইসরাঈল মানে ইসরাঈলের বংশধর। তাওরাত ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে ইহুদি ইতিহাসকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুগে ভাগ করা যায়, যেগুলো ইতিহাস, নবুয়ত, রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং ধর্মীয় দায়বদ্ধতার নিরিখে এক একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। নিচে সেই যুগগুলোকে সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো—
১. আকাবিরের যুগ
২. মিসর থেকে প্রস্থান ও ফিলিস্তিনে আগমন
এই যুগ ইহুদি ইতিহাসের এক বিশেষ বাঁক। মিসরে বনি ইসরাঈল দাসত্ব, নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার জীবনযাপন করছিল। তখন আল্লাহ তাদের মুক্তি দেন মূসা (আ.)-এর মাধ্যমে। ফিরাউনের চরম ঔদ্ধত্য, অলৌকিকভাবে তার পতন, লোহিত সাগরের পার হওয়া এবং সিনাই মরুভূমির দুর্ভোগ—সব মিলিয়ে এক মহাকাব্যিক ইতিহাস রচিত হয়। এই সময়েই আল্লাহ তাওরাত নাজিল করেন, যা ছিল শরিয়তের ভিত্তিভূমি। অতঃপর ইয়ুশা (আ.)-এর নেতৃত্বে তারা ফিলিস্তিন প্রবেশ করে। এটি ছিল একটি নবজাগরণের যুগ—আধ্যাত্মিক দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং একটি স্বতন্ত্র জাতিরূপে আত্মপ্রকাশের কাহিনি।
৩. কাজি বা বিচারকদের যুগ
৪. রাজত্বের যুগ
এ সময় ইহুদি জাতির রাষ্ট্রীয় উত্থান ঘটে। নেতৃত্বে ছিলেন— তালুত (আ.) প্রথম রাজা; দাউদ (আ.) সুর ও শৌর্যের প্রতীক; সুলাইমান (আ.) জ্ঞান ও জাঁকজমকের এক অদ্বিতীয় রাজা। এই রাজত্বের মোট স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ১২০ বছর। এই সময়কে বলা যায় বনি ইসরাঈলের স্বর্ণযুগ। শাসন, ধর্ম, প্রশাসন ও সংস্কৃতি সবই ছিল এক ঐক্যবদ্ধ মহিমায় উদ্ভাসিত। বিশেষ করে সুলাইমান (আ.)-এর শাসনে যে বর্ণাঢ্য জ্ঞান-রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পায়, তা আজও কিংবদন্তির মতো স্মরণীয়।
৫. বনি ইসরাঈলের রাজত্ব বিভাজনের যুগ
এই বিভাজন ছিল কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তিরও সূচক। সময়ের পরিক্রমায় উভয় রাজ্যই পতনের দিকে ধাবিত হয়।
১. উত্তরাঞ্চলের রাজ্য ইসরাঈল খ্রিস্টপূর্ব ৭২১ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
২. দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য ইয়াহূদা খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে বিলীন হয়ে যায়। এই ধ্বংস ইঙ্গিত করে সেই ধর্মবিচ্যুতির দিকে, যেখানে অহঙ্কার, অনাচার ও বিধানচ্যুতি ইহুদি জাতিকে তাদের পূর্বতন গৌরব হারাতে বাধ্য করেছিল।
৬. প্রথম নির্বাসনকাল
ইতিহাসের এই অধ্যায়টি বনি ইসরাঈলের জন্য এক গাঢ় শোকগাথা। সুলাইমান (আ.)-এর মৃত্যুর পর বনি ইসরাঈলের রাজত্ব দ্বিখণ্ডিত হয়। উত্তরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসরাঈল’ নামে একটি রাজ্য, যা ছিল ১০টি গোত্রের সম্মিলন। কিন্তু তাদের একনিষ্ঠতা ও ধার্মিকতার অভাব, অবাধ্যতা ও শিরকের প্রবণতা তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত, এই ১০ গোত্রকে এমনভাবে নির্বাসিত করা হয় যে ইতিহাসের পাতায় তারা ‘হারিয়ে যাওয়া ভেড়া’ (Lost Sheep of Bani Israel) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আজও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না—এই জাতি কোথায় হারিয়ে গেল!
এরপর ইতিহাসে আরও একটি গাঢ় রজনী আসে : খ্রিস্টপূর্ব ৬০৬ সাল থেকে ৫৩৬ সাল পর্যন্ত, প্রায় ৭০ বছরব্যাপী সময়কাল—যা পরিচিত ‘বাবেলীয় নির্বাসন’ নামে। এই সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য ইয়াহুদার পতন ঘটে এবং অসংখ্য ইহুদিকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় বাবেল (বর্তমান ইরাক)-এ। তাদের তন্ময়তা, উপাসনা, ও স্বাধীনতা—সবই বন্দিত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে যায়।
৭. বাবেল থেকে প্রত্যাবর্তন ও পারস্য অধীন বনি ইসরাঈল
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি, পারস্যের শক্তিশালী সম্রাট কুরুশ (Cyrus the Great) বাবিল জয় করেন। তাঁর উদারনীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ফলে নির্বাসিত ইহুদিদের জন্য খুলে যায় প্রত্যাবর্তনের দ্বার। তারা ফিরে আসে পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসে। পারস্য বাদশাহদের সহযোগিতায় সুলাইমান (আ.)-এর নির্মিত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস (হায়েকাল/টেম্পল) পুনরায় নির্মাণের অনুমতি ও সহায়তা পায়। এ এক আশার উজ্জ্বল প্রত্যাবর্তন, যেখানে দীর্ঘ বঞ্চনার পর তারা পুনরায় তাদের পবিত্র ভূমি ও ধর্মীয় রীতিতে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।
৮. ইহুদি জাতি গ্রিকদের (ইউনানীয়দের) অধীনে
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ সাল থেকে ১৬৭ সাল পর্যন্ত সময়কাল ইহুদি জাতির জন্য ছিল গ্রিক সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটি গভীর সংঘর্ষময় অধ্যায়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাম্রাজ্য বিস্তার এবং তার উত্তরসূরিদের শাসনে ইহুদি সমাজ হেলেনীয় চিন্তা-সংস্কৃতির সঙ্গে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। ধর্মীয় আদর্শ, জাতিগত পরিচয় এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ—সবকিছু ছিল এক চরম পরীক্ষার মধ্যে।
৯. স্বাধীনতার যুগ
১৬৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৩ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দী ইহুদিরা তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে। এটি ছিল মাকাবিদের (Maccabees) নেতৃত্বে এক বিপ্লবের ফলাফল, যারা ধর্ম ও স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নেয়। এই সময় তারা স্বশাসন ও ধর্মীয় পুনর্জাগরণ লাভ করে। কিন্তু এরপর দীর্ঘ প্রায় দুই হাজার বছর—১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ততারা আর কখনো স্বাধীনভাবে কোনো রাষ্ট্র কায়েম করতে পারেনি।
এক্ষেত্রে কোরআনের এক গূঢ় আয়াত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে—‘তাদের ওপর অপমানের শিকল চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর কোনো দয়ার দড়ি কিংবা মানুষের কোনো শক্তিশালী আশ্রয় পায়।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১২)
১০. রোমান শাসনের অধীনে বনি ইসরাঈল
এই শাসনকাল দুই ভাগে বিভক্ত
(ক) প্রথম ধাপ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সাল থেকে, চলতে থাকে ঈসা (আ.)-এর আগমন, তাঁর আসমানে উত্তোলন এবং ইহুদিদের দ্বিতীয় নির্বাসনের (৭০ খ্রিস্টাব্দ) আগপর্যন্ত। এই সময় রোমানদের অত্যাচার ও ঈসা (আ.)-এর প্রতি অবিশ্বাস ইহুদি জাতিকে আবারও বিধ্বস্ত করে তোলে।
(খ) দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম ধ্বংসের পর এবং রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত। এই সময় ইহুদিরা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়্তেবিচ্ছিন্ন, বিতাড়িত এবং হতবিচার।
১১. খ্রিস্টানদের শাসনে ইহুদি জাতি
যখন রোমান সম্রাট কন্সট্যানটাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন, তখন থেকে ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে খ্রিস্টান প্রভাব বিস্তার লাভ করে। এই সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত ইহুদি জাতি খ্রিস্টান রাজনীতির ছায়াতলে বসবাস করে আসছে। কখনো দমন, কখনো সহন, আবার কখনো সহবাস—এই যুগ এক অস্থির সহাবস্থানের প্রতিচ্ছবি।
১২. মুসলিম শাসনে ইহুদিরা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুয়তের যুগ থেকেই মুসলিম সমাজের সঙ্গে ইহুদি জাতির সম্পর্ক শুরু হয়। এরপর ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে উমর (রা.)-এর হাতে জেরুজালেম বিজয়ের মাধ্যমে ইহুদিদের মুসলিম শাসনের অধীনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। আরব, ইরান, ও অটোমান সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় তারা অনেক সময় সম্মানজনকভাবে, আবার কখনো নিপীড়িতভাবে দিনাতিপাত করেছে। তবে তুলনামূলকভাবে, মুসলিম শাসন তাদের জন্য খ্রিস্টান শাসনের চেয়ে অনেক বেশি সহনশীল ও ন্যায্য ছিল।
১৩. আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্র ও বর্তমান সময়
১৯৪৮ সালের ১৪ মে—ইতিহাসের সেই কালো দিন, যেদিন আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার ছত্রছায়ায় একটি বিতর্কিত জাতিগোষ্ঠী একটি বিতর্কিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ‘ইসরায়েল’। এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব একটি অব্যক্ত আতঙ্কের নাম, যেখানে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল, মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বৈতনীতি এক ভয়ংকর ইতিহাস গড়ছে। এই অধ্যায় এখনো চলছে এবং এর শেষ কোথায়—তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
জামিয়া মাদানিয়া শুলকবহর, চট্টগ্রাম।
arfasadibnsahin@gmail.com
তথ্যঋণ
মাআরিফুল কোরআন/আল্লামা মুফতি শফী (রহ.)
তারিখে ইসলাম/মাওলানা আকবর শাহ খান
রহমাতুল্লাহি লিল আলামিন/মাওলানা সাইয়িদ সুলাইমান মানসুরপুরী
কাসাসুল আম্বিয়া/মাওলানা হিফজুর রহমান
মাউসুআতুল ইয়াহুদ ওয়াল ইয়াহুদিয়্যাহ/ড. আবদুল ওয়াহাব
The New English Bible (Oxford University Press Cambridge University press-1970)
Talmood
Lions hand book to the Bible
Encyclopaedia of religion & Ethics