মানব জীবনকে মোটামুটি ভ্রুণ বা মাতৃগর্ভকাল, শৈশব, কৈশোর ও বয়ঃসন্ধি, যৌবন, প্রৌঢ় ও বার্ধক্যকাল এই ছয় ধাপে ভাগ করা যায়। সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন এবং দীর্ঘায়ু লাভের জন্য প্রতিটি ধাপ বা কাল সম্বন্ধে জানা এবং সচেতন থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে আলোচ্য বিষয় মানব জীবনের তৃতীয় ধাপ-কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকাল।
কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকাল প্রায় একই সময় শুরু হলেও এক নয়। কৈশোর শুরু হয় ১০-১২ বছর বয়স থেকে। এ সময় ব্যক্তির দৈহিক বৃদ্ধির পাশপাশি মানসিক ও সামাজিক বিকাশ শুরু হয়। আমাদের দেশে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়ারা এ সময়কালের নায়ক-নায়িকা। পরিবারের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে কার্যত মানসিক ও সামাজিকভাবে আত্মনির্ভরশীল বা স্বাধীন মানুষ হওয়ার সংগ্রামী জীবন পর্ব এটা। দৈহিক বৃদ্ধির পরিণতি বা সমাপ্তি ঘটে ২৩-২৫ বছরে।
শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের পথে ব্যক্তির শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। এ সময় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে গ্রোথ হরমোন নামে একটি রাসায়নিক যৌগ নিঃসরণ হয়। এই হরমোনের প্রভাবে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ে পরিবর্তন হয় এবং এরা টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেন নামক হরমোন তৈরি করে। এদের প্রভাবে চুল, ত্বক, হাড়, বিভিন্ন অঙ্গ ও মাংসপেশিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। একে বলে বয়ঃসন্ধি বা বয়ঃপ্রাপ্তি। বয়ঃসন্ধি কাল খুবই সংক্ষিপ্ত সময়। এর মেয়াদ মাত্র এক থেকে তিন বছর। পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়াদের জীবনে এ কালটা অতিক্রম করে। এ সময় ছেলে-মেয়েদের যৌনতার বিকাশ ঘটে। মেয়েদের পরিবর্তন শুরু হয় ছেলেদের চেয়ে এক বছর আগে। এ সময় ব্যক্তি-জীবনটা থাকে বড়ই আবেগপ্রবণ। কারণ শরীর খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। তাল সামলানো কঠিন হয় বা প্রায়ই পারা যায় না। হরমোন বৃদ্ধির কারণে মেয়েদের শরীর থেকে মেয়েলি গন্ধ এবং ছেলেদের শরীর থেকে পুরুষালি গন্ধ প্রকটভাবে ছড়াতে থাকে। উভয়ের নরম চামড়া ভেদ করে, বিশেষ করে মুখে ফুসকুড়ি বা ব্রণ উঠতে থাকে। পুরো বয়ঃসন্ধি কালেই এ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এ
ছেলেদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন: দেহের উচ্চতা বাড়ে। মাংসপেশী দৃঢ় হতে থাকে। লিঙ্গ বড় ও মোটা হয়। অণ্ডকোষ ঝুলে যায় ও বড় হয়। মুখে গোঁফ-দাড়ি, বগলে, বুকে ও তলপেটে লোম এবং লিঙ্গের গোড়ায় যৌনকেশ গজায়। গলার স্বর অল্প সময়ের জন্য ভেঙে যায় ও ভারী হয়। মুখে তেল বাড়ে ও ব্রণ হয়। দেহে শুক্রকোষ তৈরি হয়।যৌন কামনা বাড়ে ও বীর্যপাত বা ‘স্বপ্নদোষ’ শুরু হয়। সন্তান জন্মদানে সক্ষম হয়।
দশ থেকে চৌদ্দ বছর বয়সকালেই দৈহিকভাবে ছেলেরা সন্তান জন্মদান এবং মেয়েরা গর্ভধারণ করতে সক্ষম হলেও, পূর্ণাঙ্গ নর ও নারী কিংবা মা ও বাবা হওয়ার মতো সম্ভাবনা শক্তি তখনও সুপ্ত থাকে। দৈহিক পরিপুষ্টি, মানসিক প্রস্তুতি, আর্থিক ও সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কোনটাই এ সময় ব্যক্তির অনুকূল থাকে না অথচ দেহে ও মনে একটা তাড়না প্রতিনিয়ত অনুভূত হয়। এ জন্য মনোবিজ্ঞানী বা শারীরবিজ্ঞানীরা এ সময়টাকে মানবজীবনের সবচেয়ে ‘ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ’ (storm & stress) কাল বলে গণ্য করেন ।
এ সময় প্রত্যেক ছেলে-মেয়ের মনে অনেক রকম প্রশ্ন ও আশঙ্কা জাগে, ভয়-ভীতি সঞ্চারিত হয়, উদ্বেগ কাজ করে। কেন করে, তার কারণ সে নিজেও বোঝে না বা কাউকে সহজে বুঝিয়েও বলতে পারে না। অজানাকে জানতে চায়, অচেনাকে চিনতে চায়। নতুনের প্রতি কৌতুহল বাড়ে। যিনি তাকে বুঝতে চান এবং তার প্রতি সহানুভূতি দেখান, তার কাছেই সে আব্দার করে, প্রশ্ন করে বা জানতে চায়। তাই, এসময় মা-বাবা, বড় ভাই-বোন ও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে তাদের প্রতি সহজ ও সহনশীল হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিশোর বয়সীদের এসব সমস্যার যদি সঠিক ও বাস্তব সমাধান মা-বাবা, বড় ভাই-বোন, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং চিকিৎসক বা পরামর্শকের কাছ থেকে না পায়, তবে তারা কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ভুল তথ্য এবং বিকৃত চিন্তা-ভাবনার শিকার হয়। অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। এমনকি মানসিক বিষণ্ণতা রোগেও আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। যার প্রতিফলন ঘটে বিভিন্ন কিশোর অপরাধের মাধ্যমে-যেমন ধূমপান, মদ্যপান, মাদক সেবন, এইচআইভি সংক্রমণ, পুষ্টিহীনতা, যৌনবিকৃতি এবং সহিংসতা- যা প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় আমরা দেখতে পাই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও-র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের বড় একটা অংশের অসুস্থতার অন্যতম কারণ বিষণ্ণতা। অনেক কিশোর-কিশোরীই বয়ঃসন্ধিকালে শুরু হওয়া মানসিক অসুস্থতা বয়ে বেড়ায় জীবনভর। সারা বিশ্বের মানসিকভাবে অসুস্থ প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত অর্ধেকের মাঝে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায় বয়স ১৪ পূর্ণ হওয়ার আগে।
করণীয়
বয়ঃসন্ধিকালে মা-বাবা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার পবিত্র দায়িত্ব এই উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে/ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া। তাদের পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া, তাদের দেহে যে পরিবর্তন হচ্ছে বা হবে সে সম্পর্কে জানান দেয়া। তাদের সঙ্গে সহজ-সাবলীল, বন্ধুভাবাপন্ন ও সহনশীল আচরণ করা। তাদের চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং আন্তরিক ও যত্নবান হওয়া। তাদের মুক্ত পরিবেশে চলাফেরা করার সুযোগ দেয়া। খেলা-ধুলা, সাহিত্যকর্ম, বিতর্ক, আবৃতি, অভিনয়, নাচ, গান-বাদ্য, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য তৈরি প্রভৃতি শিল্পকর্মে (performing arts) অংশগ্রহণ এবং নৈপুণ্য অর্জনে উৎসাহ দেওয়া এবং সাহায্য করা। এ জন্য পরিবারে, স্কুলে এবং কমিউনিটিতে সাধ্যমতো খেলা-ধুলা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
এ সময় মা-বাবা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য তারে শান্তনা দেওয়া এবং এটা বোঝানো যে, তাদের ভুলের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তারা মোটেই দায়ী নয়। সে যেন কিছুতেই নিজেকে দোষী বা অপবিত্র মনে না করে।
কিছু কিছু বাবা-মা আছেন যারা তাদের ছেলে-মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন নানান সমস্যা নিয়ে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ফলে ছেলে-মেয়েদের সমস্যার সমাধান করতে সহজ হয়। আবার কিছু কিছু বাবা-মা এটা কিছুতেই মানতে চান না যে, তাদের ছেলে-মেয়ের কোন রকম সমস্যা রয়েছে। তারা উল্টো স্কুলকেই এসবের জন্য দায়ী করেন। এই ধরনের বাবা-মায়ের সমস্যাই আগে দূর করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচান করার জন্য মিটিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
কিছুদিন পর পরই বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে ছেলে-মেয়েদের নানারকম সমস্যা নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।
ছেলে মেয়েদের ইচ্ছা মতো টাকা দিওয়া যাবে না। এতে তারা বাজে নেশার দিকেও ঝুঁকতে পারে। তাই বাবা-মাকে আগে ব্যাপারটা বুঝতে হবে।
বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আগে এটা জানতে হবে যে ছাত্র-ছাত্রীর মেধার ঝোঁক কোন দিকে বেশি। যেদিকে ঝোঁক বেশি সেদিকেই তাদের উৎসাহ দিতে হবে। তাহলে তারা আর বিরোধিতামূলক আচরণ করবে না।
একটা বয়সে যে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন হয়, এটা তাদের আগে ভাগে জানাতে হবে। তাহলে এসব নিয়ে তাদের মনে ভয়-ভীতি কাজ করবে না। তারা পরিবর্তনটাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করবে। এই দায়িত্ব হচ্ছে বাবা-মায়ের। স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাও এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। মা-বাবা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পক্ষে কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকালের সন্তান/শিক্ষার্থীকে সামলানো বা তার সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব হলে, দেরি না করে অবশ্যই মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক-এর পরামর্শ নিতে হবে।
সূত্র: ইন্টারনেট