পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম রান্না কোনটি- এই প্রশ্নের জবাবে ডিম সেদ্ধ করার কথা বলবেন এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বরং ডিম সেদ্ধ করাকে অনেকেই হয়তো সবচেয়ে সহজ রান্নার তালিকায় ওপরের দিকে রাখবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একটি ডিমকে একেবারে নিখুঁতভাবে সেদ্ধ করা যতটা সহজ বলে মনে হয় ততটা হয়তো নয়। জ্বলন্ত উনুনে পানিভর্তি পাত্রে ডিম ছেড়ে দিলেই সেদ্ধ হয়তো হবে, কিন্তু ডিমের ওপরের সাদা অংশ ও ভেতরের কুসুম দুটোই ঠিকঠাক সেদ্ধ হবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়।
ডিম সেদ্ধ করার ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ডিমের সাদা অংশ ও কুসুম দুটোকেই নিখুঁতভাবে সেদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন হয় দুটি ভিন্ন তাপমাত্রার। ডিমের কুসুম ঠিকভাবে সেদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১৪৯ ফারেনহাইট), আর সাদা অংশটি (যার নাম অ্যালবুমেন) ভালোভাবে সেদ্ধ করার জন্য দরকার হয় তার চেয়ে একটু বেশি ৮৫ ডিগ্র সেলসিয়াস (১৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার।
ফলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ডিম সেদ্ধ করলে দেখা যায় ডিমের কুসুমটি নরম হয়েছে ঠিকই কিন্তু সাদা অংশটি পিচ্ছিল ও জলের মতো রয়ে গেছে। আবার কখনও কখনও উলটোটিও হয়ে থাকে। দেখা যায়, সাদা অংশটি নরম হয়েছে যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই, কিন্তু ভেতরের কুসুম জমে গিয়ে শুকনো ও গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে।
দৈনন্দিন জীবনে ডিম সেদ্ধ করার প্রচলিত পদ্ধতিতে তাই ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (কুসুমের জন্য) ও ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (সাদা অংশের জন্য)- এই দুটোর মাঝামাঝি একটি রাস্তা খুঁজে নেওয়া হয়। ধরা যাক, একটি ডিমকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াম তাপমাত্রায় সেদ্ধ করা হলো। তাতে দেখা যাবে ডিমটি পুরোপুরি সেদ্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে যেমনটা হলে নিখুঁত বলা যায় তা হয়নি। সাদা অংশটি নরম হয়েছে, কিন্তু শক্ত হয়ে জমে গেছে ভেতরের কুসুম। নরম আর কিছুটা তরল কুসুম যাদের পছন্দ তাদের যে এতে মন উঠবে না সেটাই স্বাভাবিক।
তবে এবারে গবেষকরা তাদের গবেষণায় ডিম সেদ্ধ করার নিখুঁত একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এই পদ্ধতিতে ডিম সেদ্ধ করা হলে ডিম শুধু সুস্বাদুই হয় না, স্বাস্থ্যের জন্যেও বেশ ভালো হয় বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।
ডিম সেদ্ধ করার নিখুঁত যে উপায় বের করলেন গবেষকরা
ডিম সেদ্ধ করার নতুন পদ্ধতিকে পিরিয়ডিক কুকিং বা পর্যায়ক্রমিক রান্না নামে আখ্যায়িত করেছেন গবেষকরা। এই প্রক্রিয়ায় একটি ডিমকে একবার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার ফুটন্ত গরম জলে, আরেকবার ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রার হালকা গরম জলে রাখা হয়। প্রতি ২ মিনিট অন্তর ডিমটিকে ভিন্ন দুটি তাপমাত্রায় স্থানান্তর করতে হয়।
ডিম সেদ্ধ করার নিখুঁত পদ্ধতিটি যেভাবে বের করলেন গবেষকরা
ইতালির পোজ্জুওলিতে অবস্থিত ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে কর্মরত বিজ্ঞানী পেলেগ্রিনো মুস্টোর নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রথমে কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডায়নামিক্স (সিএফডি) ব্যবহার করে ডিম সেদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াটি সিমুলেট বা অনুকরণ করেন। সিএফডি হলো বিজ্ঞানভিত্তিক এমন এক পদ্ধতি যেখানে কম্পিউটার ব্যবহার করে তরল ও গ্যাসের প্রবাহ কীভাবে কাজ করে তা অনুমান করা হয়। এটি ভর, গতি ও শক্তি সংরক্ষণের মতো ভৌত নিয়মগুলোর (ফিজিক্যাল ল’জ) ওপর ভিত্তি করে কাজ করে থাকে।
কম্পিউটারের সাহায্যে সিমুলেশন বা অনুকরণের মাধ্যমে গবেষকরা ডিম সেদ্ধ করার নতুন এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছেন, যেটা সাধারণ রাঁধুনিদের কাছে একেবারেই নতুন বলে মনে হবে। গবেষকরা বলছেন, এই পদ্ধতিতে ডিম যেমন খুব ভালোভাবে সেদ্ধ হবে তেমনি অক্ষুণ্ণ থাকবে এর পুষ্টিগুণও। একেই তাঁরা ‘পিরিয়ডিক কুকিং’ বা পর্যায়ক্রমিক রান্না নামে অভিহিত করেছেন।
গবেষকরা এই পদ্ধতিতে ডিম সেদ্ধ করে অসাধারণ ফল পেয়েছেন। তাঁরা নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স আর হাই-রেজোলিউশন মাস স্পেকট্রোমেট্রি ব্যবহার করে ডিমের গঠন, স্বাদ আর রাসায়নিক উপাদান পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের পরীক্ষায় নতুন এই পদ্ধতিতে ডিম সেদ্ধ করার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, পর্যায়ক্রমিক রান্নায় ডিমের সাদা অংশ ও কুসুম দুটোই নরম থাকে, ঠিক ততটাই যতটা হলে একে নিখুঁত বলা যায়। অর্থাৎ, গবেষকদের নতুন এই পদ্ধতি অনুসরণ করে একেবারে নিখুঁতভাবে ডিম সেদ্ধ করা যায় । কীভাবে এটা সম্ভব?
গবেষকদের মতে, পর্যায়ক্রমিক রান্নায় (পিরিয়ডিক কুকিং) ডিমের সাদা অংশটির তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত ওঠানামা করে। কিন্তু ডিমের কুসুমটা পুরোটা সময় ৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৫৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় থাকে। আর তাতেই মেলে নিখুঁতভাবে সেদ্ধ হওয়া একটি ডিম।
পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে সেদ্ধ করা ডিমের কুসুমে প্রচলিত পদ্ধতিতে সেদ্ধ করা ডিমের কুসুমের তুলনায় পলিফেনল বেশি থাকে। সেদ্ধ ডিমের রাসায়নিক পরীক্ষায় এই প্রমাণ পেয়েছেন বলে গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন গবেষকরা।
পলিফেনল হচ্ছে একগুচ্ছ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট- যেটা একাধিক পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সাধারণত বিভিন্ন উদ্ভিদে পাওয়া যায় এই পলিফেনল এবং স্বাস্থ্যের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারি। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে এবং প্রদাহ কমানোর জন্যেও পলিফেনল সুপরিচিত। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি, খরা ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন উদ্ভিদ এই পলিফেনল তৈরি করে থাকে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু উদ্ভিদের জন্যেই নয়, মানুষের জন্যেও বেশ উপকারী এই পলিফেনল। গবেষকদের মতে, পলিফেনল সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে হৃদরোগ, স্নায়ুর রোগসহ নির্দিষ্ট কয়েক প্রকার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, সায়েন্স নিউজ