নামাজের পর জাকাত ইসলামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। পবিত্র কোরআনে ৩২ স্থানে নামাজ ও জাকাত ফরজ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা : ২০২)
জাকাতের গুরুত্ব বুঝতে এটিই অনুমেয় যে মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর আরব বিশ্বের সর্বত্র বিদ্রোহ শুরু হয়, যা ইসলামী রাষ্ট্রকে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি এবং সংকটাপন্ন ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়। এর নেপথ্যে ছিল জাকাত অস্বীকারকারীরা। তত্কালীন সময়ে এটি ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইসলামী ইতিহাসের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে (Critical juncture) আবু বকর সিদ্দিক (রা.) অধিকাংশ সাহাবির পরামর্শক্রমে) ঘোষণা করেন যে যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে যেকোনো পার্থক্য এবং বৈষম্য সৃষ্টি করবে, আমি তার বিরুদ্ধে জিহাদ করব। অতঃপর আমিরুল মুমিনিন আবু বকর সিদ্দিক (রা.) জাকাত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জিহাদ করেন এবং তাদের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে চূর্ণ না করা পর্যন্ত তাঁর তরবারি ক্ষান্ত হয়নি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪০০)
জাকাতের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্রতা, বরকত ও বৃদ্ধি। পারিভাষিক অর্থ হল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শরীয়ত দ্বারা নির্ধারিত সম্পদের একটি অংশ একজন মুসলিম দরিদ্র ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া। যাতে তা দ্বারা সে সম্পূর্ণরূপে ব্যয় করতে সক্ষম হয়। (ফিকহুল ইবাদাত আলা আল-মাযহাবিল হানাফিয়্যাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা : ১৪৬)
জাকাত ফরজ। যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের আর যে আদায় করবে না সে ফাসেক এবং যে এর আদায়ে বিলম্ব করবে সে গুনাহগার হবে। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা : ৩০৯, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৬৮)
জাকাত যাদের ওপর ফরজ
যে ব্যক্তি মুসলিম, বোধসম্পন্ন, সুস্থ-মস্তিষ্ক ও প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী। যদি সম্পদ মৌলিক চাহিদার চেয়ে বেশি হয় এবং যদি এই সম্পদের ওপর পুরো এক বছর অতিবাহিত হয় তাহলে তার উপর জাকাত ফরজ। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৫৮)
নিসাব মানে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য উভয়ের মূল্যের সমপরিমাণ অথবা উভয়ের একটির মূল্যের সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা বাণিজ্যিক মালামাল বা এ সকলের সমন্বয় কিংবা এগুলোর সামষ্টিক কিছু জিনিস রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হতে হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪৪৭; বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ৮২)
উল্লেখ্য যে অসুস্থ মস্তিষ্ক মুসলিমের ওপর এবং নাবালেগ বাচ্চাদের ওপরও জাকাত ফরজ নয়। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৫৯)
জাকাতের টাকা, মালামাল এবং সম্পদ জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার সময় জাকাতের নিয়ত করা। অর্থাত্ অন্তরে এই নিয়ত এবং ইচ্ছা পোষণ করা যে আমি জাকাত আদায় করছি। (ফাতাওয়ায়ে শামী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৬৮)
জাকাতের টাকা, মালামাল এবং সম্পদ পৃথক করার সময় সে জাকাতের নিয়ত করল, কিন্তু জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার সময় নিয়ত করেনি তাহলেও তার জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা : ১৭০)
জাকাতের আধুনিক হিসাব
জাকাতযোগ্য সব সম্পদের চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর আড়াই শতাংশ (৪০ ভাগের ১ ভাগ) হারে প্রদান করতে হয়। চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে হয়, যেহেতু সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে বা ৩৬৬ দিনে হয়, তাই সৌরবর্ষ অপেক্ষা চান্দ্রবর্ষ ১০ বা ১১ দিন কম। সৌরবর্ষ হিসাবে জাকাত প্রদান করতে চাইলে শতকরা ২ দশমিক ৫ শতাংশের পরিবর্তে ২ দশমিক ৫৭৮ শতাংশ বা ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ দিতে হবে। অথবা মূল জাকাতের সঙ্গে অতিরিক্ত ১১ দিনের হিসাব যোগ করতে হবে। অনুরূপ কারও জাকাত সমাপনী হিসাব তারিখ রমজানে না হলে, সে অতিরিক্ত সময়ের জাকাত সমন্বয় করে রমজানে জাকাত হিসাব তারিখ নিয়ে আসতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে খানিয়া, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা : ১৫৫)
জাকাতের সমকালীন মাসআলা
ঋণের টাকায় জাকাত : যদি ঋণের টাকা নিসাব সমপরিমাণ হয় বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে তা উসুল করার পর তার জাকাত আদায় করা আবশ্যক। আর যদি ঋণের টাকা উসুল হতে কয়েক বছর সময় লেগে যায় তাহলে টাকা হাতে আসার পর অতিবাহিত হওয়া প্রতিটি বছরের জাকাত আদায় করতে হবে। (আদ-দুররুল মুখতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ৩০৫)
ওষধের উপর জাকাত : দোকানে মওজুদকৃত ঔষধসমূহের উপর জাকাত দেওয়া আবশ্যক। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৮৮)
স্টেশনারি দোকান : স্টেশনারির দোকানে বিক্রির জন্য যে মালই মওজুদ থাকুক না কেন যদি সেগুলোর নিসাব পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে উক্ত মালের উপর জাকাত ওয়াজিব। তাই সেগুলোর উপর বিক্রিত মূল্য থেকে বার্ষিক শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়ায়ে খানিয়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৩৭)
ব্যবসার পুঁজি ও লভ্যাংশ : ব্যবসার পুঁজি ও লাভ উভয়ের উপর জাকাত ওয়াজিব। শুধু মূল্যের উপরও হয় না আবার শুধু লাভের উপরও হয় না, বরং উভয়ের সমন্বয় পরিমাণের উপর জাকাত ওয়াজিব হয়। (আল বাহরুর রায়েক, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২২২)
প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র জাকাত দ্বারা ক্রয় করা : জাকাতের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র ক্রয় করলে জাকাত আদায় হবে না। কেননা তার মধ্যে মালিকত্ব দান হয় না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা : ১৭০)
জাকাতের অর্থ দ্বারা ইফতারির পণ্য প্রদান: যদি ইফতারকারী ব্যক্তি গরীব এবং জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত হয় তাহলে জাকাতের অর্থ দ্বারা ইফতারির ব্যবস্থা করা জায়েজ হবে। তবে বণ্টনের পদ্ধতি হল এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে ইফতারের পণ্য পৃথক পৃথক দিতে হবে। যেন মালিকত্ব দান হয়ে যায়। অন্যথায় জাকাত আদায় হবে না। (ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৫৭)
উল্লেখ্য যে যদি ইফতারকারী ব্যক্তি ধনী হয় তাহলে জাকাতের অর্থ দ্বারা ইফতারির আয়োজন করা জায়েজ হবে না এবং জাকাতও আদায় হবে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা : ১৮৯)
জাকাত হিসেবে বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদান : জাকাত হিসেবে জিনিসপত্র দেওয়া জায়েজ। উদাহরণস্বরূপ : কাপড়, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি জাকাত হিসেবে দওয়া জায়েজ। (আদ-দুররুল মুখতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৮৫)
ব্যাংকের সুদের বিধান : ব্যাংকের সেভিং একাউন্টে যে সুদ জমা হয় সেটা নেওয়া নাজায়েজ ও হারাম। (সুরা আন নিসা, আয়াত : ১৬১)
সুতরাং সুদের টাকার ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। যদি কোনো ব্যক্তি সুদের টাকা নেয়। তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো সুদের টাকা ফিরিয়ে দিবে, যদি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় আর যদি সম্ভব না হয় তাহলে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সুদের টাকা সদকা করে দেবে। (ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৯১)
ফিক্সড ডিপোজিট (Fixed Deposit): ফিক্সড ডিপোজিট একটি সুদি ইস্কিম। সুতরাং তাতে টাকা জমা করা এবং লাভের নামে সুদ নেওয়া শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে নাজায়েজ ও হারাম। যদি কোনো ব্যক্তি ব্যক্তি এ বিষয়টি না জেনেই নিজ টাকা ফিক্সড ডিপোজিটের মধ্যে জমা করে, তখন তা তার জন্য সেখান থেকে বের করে নেওয়া উচিত।
অতএব যদি টাকা বের করা মুশকিল হয় তাহলে বার্ষিক আসল টাকা থেকে শতকরা আড়াই টাকা হারে জাকাত আদায় করবে আর লাভের নামে যে টাকা অন্তর্ভুক্ত হবে তা নেবে না। তারপরও যদি কোনো ব্যক্তি নিয়ে নেয় তাহলে ফেরত দিয়ে দিবে—যদি তা সম্ভব হয়। আর সম্ভব না হলে তখন জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত কাউকে সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই দিয়ে দেবে; যাতে পরকালের আজাব থেকে বাঁচতে পারে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা : ৩৪৯)
ঘুষের অর্থের ওপর জাকাত : ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া উভয়টিই হারাম। রাসুল (সা.) বলেছেন : উভয়েই জাহান্নামে যাবে এবং জাহান্নামের শাস্তি বরদাশত করা সম্ভব হবে না। (সুনানে জামে আত-তিরনিজি, হাদিস : ১৩৩৬)
সুতরাং ঘুষের মালের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। যদি এটা প্রকাশ হয় যে ঘুষের টাকা কার কাছ থেকে নিয়েছে তখন তাকে বা তার ওয়ারিশদের ফিরিয়ে দেবে। আর জানা থাকলে তখন সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সবগুলো মাল সদকা করে দেবে। অন্যথায় গুনাহগার হবে এবং পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৯১)
আল্লাহ তাআলা আমাদের জাকাতের মাসআলা জেনে হিসাব করে সঠিকভাবে জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
arfasadibnsahin@gmail.com