spot_img

সত্যসন্ধানে রজব মাস ও শবে মিরাজ

অবশ্যই পরুন

রজব মাস ইসলাম আবির্ভাবের আগ থেকেই একটি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ স্থগিত হয়ে যেত এবং শান্তি বিরাজ করত। রজব ইসলামী বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস, যার পূর্ণ নাম ‘রজবুল মুরাজ্জব’। এই নামকরণের কারণ হলো, রজব শব্দটি ‘তারজিব’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সম্মান প্রদর্শন করা। এটি এমন একটি মাস, যা সম্মানিত ও পবিত্র হিসেবে স্বীকৃত; এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। তাই একে ‘আল আসম রজব’ বলা হয়, যার অর্থ নীরব রজব, কারণ এই মাসে অস্ত্রের কোনো শব্দ শোনা যেত না। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা : ২২৫)

এছাড়াও এই মাসকে ‘আল আসাব’ বলা হয়, কারণ এই মাসে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের ওপর রহমত ও ক্ষমার বিশেষ ধারা বর্ষণ করেন। এই মাসে ইবাদত ও দোয়া বিশেষভাবে কবুল হয়। রজব সেই চারটি পবিত্র মাসের একটি, যেগুলোর কথা কোরআনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোটি, যা আল্লাহর কিতাব (অর্থাত্ লাওহে মাহফুজ) অনুযায়ী সেই দিন থেকেই নির্ধারিত, যেদিন আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছিলেন। এই বারো মাসের মধ্যে চারটি মাস পবিত্র ও সম্মানিত।’ (সুরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩৬)

আবু বাকরা (রা.) হতে বর্ণিত : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ যে দিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, সে দিন হতে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। জুলকাদাহ, জুলহিজ্জাহ ও মুহাররাম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হলো রজব-ই-মুযার, যা জুমাদা ও শাবান মাসের মাঝে অবস্থিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৯৭)

উল্লেখ্য যে মুজার একটি সম্প্রদায়ের নাম। আরবের অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে এ সম্প্রদায় রজব মাসের সম্মান প্রদর্শনে অতি কঠোর ছিল। তাই এ মাসটিকে তাদের দিকে সম্বন্ধ করে হাদিসে ‘রজব-ই-মুজার’ বলা হয়েছে।

শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেছেন : ইব্রাহিম (আ.)-এর ধর্মে এই চার মাস ছিল সম্মান ও মর্যাদার। আল্লাহ তাআলা এই মাসগুলোর পবিত্রতা ও সম্মানকে বহাল রেখেছেন এবং আরবের মুশরিকরা যে এতে বিকৃতি ঘটিয়েছিল, তা খণ্ডন করে দিয়েছেন। (মাআরিফুল কুরআন লিল কান্ধলভী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা : ৪৩১)

২৭ রজব ও শবে মিরাজ

রজবের ২৭তম রজনীতে (২৬ তারিখ দিবাগত রাতে) প্রিয় নবী (সা.)-কে মিরাজের সফর করানো হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। যদিও মিরাজের সময়, তারিখ, মাস এমনকি বছর সম্পর্কেও ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রচুর মতবিরোধ আছে। মনে রাখতে হবে যে মিরাজের রাত যেই তারিখ বা মাসেই হোক না কেন, সেই রাতের জন্য ইসলামী শরিয়তে কোনো নির্দিষ্ট ইবাদত বর্ণিত নেই। অবশ্যই, এই রাতটি ছিল সেই পবিত্র রাত, যখন আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-কে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেন এবং তাঁকে আসমানসমূহে ডেকে নিয়ে বিশেষ বিশেষ উপহার দান করেন। কিন্তু এই বিষয়ে উম্মতের জন্য কোনো অতিরিক্ত ফজিলত বা বিশেষ ইবাদত নির্ধারিত নেই।

শবে মিরাজ উত্তম নাকি শবে কদর?

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে এই দুই রাতের (শবে কদর ও শবে মিরাজ) মধ্যে কোন রাতটি অধিক ফজিলতপূর্ণ? তিনি জবাব দিয়েছিলেন যে নবী করিম (সা.)-এর মর্যাদার দিক থেকে লাইলাতুল মিরাজ অধিক ফজিলতপূর্ণ, আর উম্মতের জন্য লাইলাতুল কদর। কারণ, লাইলাতুল মিরাজে যেসব বিশেষ পুরস্কার ও মর্যাদা প্রিয় নবী (সা.)-কে প্রদান করা হয়েছিল, তা লাইলাতুল কদরের তুলনায় অনেক বেশি। আর উম্মতের জন্য লাইলাতুল কদরে যেসব পুরস্কার নির্ধারিত হয়েছে, তা লাইলাতুল মিরাজে প্রাপ্ত পুরস্কারের চেয়েও পূর্ণতর।
যদিও উম্মতের জন্য লাইলাতুল মিরাজও একটি বড় সম্মানিত রাত, কিন্তু মূল ফজিলত ও মর্যাদা সেই মহান ব্যক্তিত্বের জন্য নির্ধারিত, যাঁকে এই মিরাজের সৌভাগ্যে ভূষিত করা হয়েছিল, অর্থাত্ আমাদের প্রিয় নবী করিম (সা.)। (মাজমাউল ফতওয়া, হাদিস নং ৭২৩, খণ্ড ২৫, পৃষ্ঠা : ১৩০)

শবে মিরাজের সময় সম্পর্কিত বিষয়ে জুমহুর উলামাদের (গবেষকদের) অভিমত নিম্নে উপস্থাপন করা হলো—
শবে মিরাজ কবে সংঘটিত হয়েছিল?

সিরাতবিদ উলামায়ে কেরামদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে যে, প্রিয় নবী (সা.)-কে মিরাজ কখন করানো হয়েছিল? এ বিষয়ে (অর্থাত্ মিরাজ যে বছরে ঘটেছিল) সাধারণত ১০টি মত পাওয়া যায়। অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে, এই ঘটনা নবুয়ত প্রাপ্তির পরে ঘটেছিল; তবে নবুওয়তের ঠিক কত বছর পর এটি ঘটেছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।

১. ইবনে সাদ (রহ.)-এর মতে, মিরাজ হিজরতের ১ বছর আগে করানো হয়েছিল।

২. ইবনে জাওজি (রহ.)-এর মতে, এটি হিজরতের ৮ মাস আগে ঘটেছিল।

৩. আবু রাবি ইবনে সালিম (রহ.)-এর মতে, এটি হিজরতের ৬ মাস আগে হয়েছিল।

৪. ইবরাহিম হারবি (রহ.)-এর মতে, মিরাজ হিজরতের ১১ মাস আগে ঘটেছিল।

৫. ইবনে আবদুল বার (রহ.)-এর মতে, এটি হিজরতের ১ বছর ২ মাস আগে হয়েছিল।

৬. ইবনে ফারিস (রহ.)-এর মতে, এটি হিজরতের ১ বছর ৩ মাস পূর্বে হয়েছিল।

৭. সাদ্দি (রহ.)-এর মতে, এটি হিজরতের ১ বছর ৫ মাস আগে ঘটেছিল।

৮. ইবনুল আসির (রহ.)-এর মতে, এটি হিজরতের ৩ বছর আগে ঘটেছিল।

৯. ইমাম জুহরি (রহ.)-এর মতে, মিরাজের ঘটনা হিজরতের ৫ বছর আগে ঘটে।

১০. এমন একটি মতও রয়েছে যে, মিরাজ নবুয়তের আগেই হয়েছিল; তবে এই মতটি অত্যন্ত দুর্বল এবং অগ্রহণযোগ্য।
এই মতসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো, মিরাজ হিজরতের ১ বছর আগে ঘটেছিল। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা : ২৫৪, সুবুলুল হুদা ওয়াল রাশাদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা : ৬৫)

মিরাজ কোন মাসে সংঘটিত হয়েছিল?

যেমনিভাবে মিরাজের ঘটনার বছর নিয়ে মতভেদ রয়েছে, তেমনি কোন মাসে এই মহিমান্বিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় ৫ মাস অথবা ৬ মাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

১. বহু আলেমের মতে, মিরাজের ঘটনা রবিউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল।

২. ইবরাহিম ইবনে ইসহাক আল হারবি (রহ.) বলেছেন যে, মিরাজের ঘটনা রবিউস সানি মাসে ঘটেছিল।

৩. আবদুল গণি ইবনে সারওয়ার আল মাকদিসি (রহ.) রজব মাসকে এই ঘটনার সময় হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই মতটিই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।

৪) সাদ্দি (রহ.) বলেছেন যে, মিরাজ শাওয়াল মাসে ঘটেছিল।

৫) ইবনে ফারিস (রহ.) বলেছেন যে, মিরাজের ঘটনা জিলহজ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। (শারহুল মাওয়াহিব লিল জুরকানি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৭০, উমদাতুল কারী, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা: ২৭)

মিরাজ কোন রাতে সংঘটিত হয়েছিল?

আল্লামা জুরকানি (রহ.) লিখেছেন যে, মিরাজের রাত সম্পর্কে তিনটি মতামত প্রসিদ্ধ। প্রথম মত হলো, এই ঘটনা শুক্রবারের রাতে সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয় মত অনুযায়ী, এটি শনিবারের রাতে ঘটেছিল, এবং তৃতীয় মত হলো, মিরাজের ঘটনা সোমবারের রাতে সংঘটিত হয়েছিল। যেহেতু মিরাজের তারিখ নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে, তাই নির্দিষ্ট কোনো রাতের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ নয়। (সুবুলুল হুদা ওয়াল রাশাদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ৬৫)

এই বিশদ আলোচনা থেকে যে বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার দাবি রাখে, তা হলো—মিরাজের ঘটনার বিশদ বিবরণ এত বিপুল সংখ্যক সাহাবি বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এত বড় ঘটনার নির্দিষ্ট রাতের তারিখ কেউ উল্লেখ করেননি, কেন?

এই প্রশ্নের জবাবে মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি (রহ.) বলেন : ওই রাতে বিদআত ও কুসংস্কার প্রসারের আশঙ্কা প্রবল ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সেই বিপদ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে এই রাতের তারিখকে অস্পষ্ট রাখাকেই প্রয়োজনীয় মনে করেছেন। (সাত মাসায়েল, পৃষ্ঠা : ১৬)

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
উচ্চতর ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ
আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রাম
arfasadibnsahin@gmail.com

সর্বশেষ সংবাদ

১ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান জারি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশাসনসূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ১ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে নিজ নিজ...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ