আলী (রা.) তখন আমিরুল মুমিনিন। ছোট্ট শিশু সাবিত এসেছিলেন আলী (রা.)-এর দরবারে। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন তাঁর বংশধরদের জন্য। দোয়ার বীজ মহিরুহ হতে বেশি সময় লাগেনি। তাঁর দোয়ার অনেক বছর পর ৮০ হিজরিতে সাবিতের বংশে নূরের বাতি জ্বালিয়ে পৃথিবীতে আসেন নুমান নামের এক তুখোর প্রতিভার অধিকারী মানব শিশু। তাঁর পুরো নাম নুমান ইবনে সাবিত ইবনে জুতি ইবনে মাহ।
গবেষকরা বলেন, ইমাম আবু হানিফার পূর্ব পুরুষরা পারস্যের সম্ভ্রান্ত বংশের লোক ছিলেন। তার মাতৃভাষা ছিল ফারসি। [ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.), ২৭ পৃষ্ঠা]
ইমাম আবু হানিফা পরিণত বয়সে বেশ কয়েকজন সাহাবির সাক্ষাৎ পেয়েছেন। ফলে জীবনীকাররা সন্দেহাতীতভাবে তাঁকে তাবেয়ি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, আনাস ইবনে মালেক (রা.), সাহল ইবনে সাদ (রা.), আবু তোফায়েল আমর ইবনে ওয়াসেলা (রা.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফাসহ (রা.) আরো কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে আবু হানিফার সাক্ষাৎ প্রমাণিত। ইমাম আজমের তাবেয়ি হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত প্রমাণ পাওয়া যায় ইবনে সাদ, খতিব আল বাগদাদি, আবদুল করিম সামআনি, ইমাম নববি, ইমাম জাহাবি, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি ও জাইনুদ্দিন ইরাকির লেখায়। (মানাকিবে ইমাম আবু হানিফা, ২৯৬ পৃষ্ঠা।)
ইমাম আবু হানিফা যখন জন্মগ্রহণ করে তখন উমাইয়া শাসক হাজ্জাজ ক্ষমতায়। হাজ্জাজের পর ক্ষমতায় আসে ওলিদ। এ দুই শাসকের সময়কালে শৈশব ও কৈশর কেটেছে আবু হানিফার। এ সময় তিনি পৈত্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করতেন। পড়াশোনা তখনো শুরু করেননি তিনি। তার ইলমি সাগরে যাত্রা শুরু হয় সুলাইমানের শাসনের সময়। এ নিয়ে একটি সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে। ঘটনাটি স্বয়ং ইমামের মুখে শোনা যাক। ‘একদিন আমি বাজারে যাচ্ছিলাম ব্যাবসার কাজে। পথে কুফার বিখ্যাত আলেম ইমাম শাবির সঙ্গে দেখা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা! তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমি একজন সওদাগরের নাম বললাম। ইমাম বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি, তুমি কারো কাছে পড়াশোনা করো কি না? আমার কণ্ঠে এক রাশ আক্ষেপ ফুটে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি কারো কাছে পড়ি না। আমার জবাব শুনে ইমাম শাবি বললেন, তোমার ভেতর আমি বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তোমার অবশ্যই আলেমদের দরসে বসা উচিত। কথাগুলো আমার ভেতর ছুয়ে গেল। আমি এলম সাধনার জন্য পাগল হয়ে গেলাম।’ (মানাকিবে ইমাম আজম, ৫৪ পৃষ্ঠা)
ইমাম আবু হানিফার উস্তাদদের মধ্যে ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কূফায় ইমাম হাম্মাদের মাদরাসা ছিল। তিনি বহু তাবেয়ির উস্তাদ। আনাস (রা.) থেকে তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি অন্যতম ফকিহ সাহাবি ইবনে মাসউদের ফিকহ শিক্ষা দিতেন। ইমাম আবু হানিফা ১০ বছর ইমাম হাম্মাদের কাছে ফিকহ শিক্ষা করেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর ইমাম হাম্মাদের মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি। ১০ বছর শেষে আমার মনে হল, এবার আমি পড়াতে পারি। কিন্তু উস্তাদের সম্মানে আমি পড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি।’ (তারিখে বাগদাদি, ১৩ খণ্ড, ৩৩৩ পৃষ্ঠা)
ইমাম হাম্মাদের মাদরাসায় পড়ার সময়ই ইলমে হাদিসের ব্যাপারে আগ্রহী হন ইমাম আজম (রহ.)। হাদিস শিক্ষার জন্য ইমাম আজম কুফার আলেমদের মজলিসে বসতে শুরু করলেন। কুফার মুহাদ্দিসদের থেকে দারস শেষ করে তিনি ইলমে হাদিসের জন্য মক্কা-মদিনায় ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি জগত বিখ্যাত মুহাদ্দিস আতা ইবনে আবু রাবাহ আল কুরাইশির কাছে ইলমে হাদিস শিক্ষা করেন। আতা ছিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। প্রায় দুই শ সাহাবির সান্নিধ্য থেকে ইলম আহরণ করেছেন তিনি। সাহাবিরাও তার মজলিসে বসত। তিনি সাহাবিদের উপস্থিতিতে ফতোয়া দিতেন এবং তার ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হতো। এছাড়াও হাফেজে হাদিস আবদুল্লাহ ইবনে ইকরিমা, সুলাইমান ইয়াসার, সালিম ইবনে আবদুল্লাসহ মক্কা-মদিনার শ্রেষ্ঠা মুহাদ্দিসদের থেকেও ইলমে হাদিস শিখেন ইমাম আজম (রহ.)। হাদিসের অন্যতম সেরা মনীষী ইমাম আওজায়ি (রহ.) ইমাম আবু হানিফাকে হাদিসের সনদ দেন।
হাদিসের জগতেও তিনি ছিলেন সম্রাট। ইমাম আজমের হাত ধরে ‘কিতাবুল আছার’ নামে প্রথম সহিহ হাদিস গ্রন্থ রচিত হয়। অসংখ্য হাদিস থেকে যাচাই বাছাই করে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেন। ছদরুল আয়িম্মা মুওয়াফফাক ইবনে মক্কি (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা ৪০ হাজার হাদিস থেকে যাচাই বাছাই করে কিতাবুল আছার সংকলন করেন। (মানাকিবু আবি হানিফা, ২৭ পৃষ্ঠা)
লেখক : মুফাসসিরে কুরআন এবং প্রিন্সিপাল, আন-নূর মাদরাসা, বাসাবো ঢাকা।