আফগানিস্তানে তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। উত্তরের শহর মাজার-এ-শরিফ থেকে রাস্তার দুপাশে ফেলে রাখা বোমা-বারুদের বাক্স পেরিয়ে ৩০ মিনিটের পথ এগোতেই দেখা মিলল বালখ জেলায় তালেবানদের ছায়া মেয়র, আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা হাজি হেকমতের সঙ্গে।
কালো পাগড়ি পরা, সুগন্ধিশোভিত হাজি হেকমত তালেবানদের দীর্ঘদিনের পুরনো সদস্য। ১৯৯০ সালে যখন দেশটি ছিল জঙ্গিশাসিত, তখনই তিনি প্রথম এই দলে নাম লেখান।
তালেবানরা আমাদের জন্য নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করেছিল। পথের দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়ানো, ভারি অস্ত্রে সজ্জিত সদস্যরা, একজনের পকেটে দেখা গেল প্রপেলড গ্রেনেড লঞ্চার, সেইসঙ্গে আছে আমেরিকান সৈন্যদের থেকে কেড়ে নেওয়া একটি এম ফোর অ্যাসল্ট রাইফেল। বালখ ছিল দেশের সবচেয়ে স্থিতিশীল অঞ্চল, আর সেটিই এখন হয়েছে উঠেছে সবচেয়ে সহিংস।
নিজের হিংস্রতার জন্যে সুপরিচিত স্থানীয় মিলিটারি কমান্ডার বারিয়ালাই সামনের রাস্তার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন, ‘সরকারি সেনাবাহিনী ওপাশে বাজারের কাছেই রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের ঘাঁটি ছেড়ে আসতে পারবে না, কারণ এই এলাকা শুধুই মুজাহিদীনের দখলে।’
তবে এটি যেন সত্যিকার অর্থে সমগ্র আফগানিস্তানেরই চিত্র। সরকার বড় শহরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সেগুলোকে ঘিরে আছে তালেবান, আর সেইসঙ্গে শহরের বাইরের বিশাল অঞ্চলগুলোও তাদের অধীনে।
মূল সড়কগুলোর দুপাশে বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের চেকপোস্ট বসিয়ে অঞ্চলগুলোতে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করে জঙ্গিরা। এসব পথ দিয়ে পার হতে থাকা গাড়িগুলোকে তালেবান সদস্যরা থামায় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর কারণ হিসেবে তালেবানের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের স্থানীয় প্রধান আমির সাহিব আজমল জানালেন, তারা আসলে সরকারের সঙ্গে যুক্ত আছে কি না, এমন লোকদের খোঁজেন।
তিনি আরও জানালেন, ‘আমরা তাদের গ্রেপ্তার করে বন্দি হিসেবে নিয়ে যাব। তারপর আমাদের আদালতে তোলা হবে তাদের এবং সেখানেই নির্ধারিত হবে তাদের ভাগ্য।’
তালেবানদের বিশ্বাস, বিজয় তাদেরই হবে। এক কাপ গ্রিন টি হাতে নিয়ে বসে থাকা হাজি হেকমত এমনটাই দাবি করলেন, ‘যুদ্ধে আমরা জিতেছি এবং আমেরিকা হেরে গেছে।’ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেপ্টেম্বর থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তার অর্থ এই দাঁড়ায়- গত বছর দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী তারা এই দেশে ১ মে পর্যন্ত থাকবে। এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক ও তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে তালেবান রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে এবং বলাই বাহুল্য, এটি তাদের নতুন করে প্রেরণা দিয়েছে।
হাজি হেকমত বলেন, ‘আমরা সবকিছুর জন্য প্রস্তুত। আমরা শান্তি আনার জন্য, জিহাদের জন্য প্রস্তুত।’
পাশেই বসে থাকা আরেক তালেবান বললেন, ‘জিহাদ একটা উপাসনার মতো। আর উপাসনা এমন একটা বিষয়, যা আপনি যতই করুন না কেন, ক্লান্ত হবেন না।’
তবে বিগত কয়েক বছর ধরে তালেবানদের ‘জিহাদ’-এ বৈপরীত্য দৃশ্যমান। আমেরিকার সঙ্গে চুক্তির পর তারা আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলোর ওপর হামলা করা বন্ধ করলেও আফগান সরকারের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও হাজি হেকমতের দাবি, এখানে কোনো বৈপরীত্য নেই: ‘আমরা শরিয়া আইনের মাধ্যমে চালিত একটা ইসলামি সরকার চাই। আমাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাব।’
আফগানিস্তানের অন্য বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেবেন কি না, সেই প্রশ্নে হাজি হেকমত জানালেন, সেটি কাতারে থাকা দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে। সেখানে তারা যে সিদ্ধান্ত নিবেন, তারা তাই মানবেন।
তালেবানরা নিজেদের নিছক বিদ্রোহী গোষ্ঠী ভাবতে নারাজ, বরং তারা নিজেদের সম্ভাব্য সরকার হিসেবে ভাবে। তারা নিজেদের ‘আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাত’ হিসেবে উল্লেখ করে। এই নাম তারা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার সময় থেকে ধরে ৯/১১-এর হামলার পর ক্ষমতাচ্যুত হবার আগ পর্যন্ত ব্যবহার করত।
বর্তমানে তাদের পূর্ণাঙ্গ একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা রয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা প্রতিটি খাতের তত্ত্বাবধান করেন।
হাজি হেকমত আমাদের নিয়ে গেলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে কিশোর-কিশোরীরা জাতিসংঘের দেওয়া বই হাতে নিয়ে বসে আছে। ১৯৯০ সালে তালেবান ক্ষমতায় এসে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল, যদিও তারা তা প্রায়ই অস্বীকার করে। এমনকি এখনো বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খবর পাওয়া যায়, নারীদের ক্লাসে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এখানে তালেবানদের দাবি, তারা নারী শিক্ষার পক্ষে।
তালেবানদের স্থানীয় শিক্ষা কমিশনের প্রধান মাওলাওয়ি সালাহউদ্দিন বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত তারা হিজাব ব্যবহার করবে এবং শরিয়া মেনে চলবে, তাদের শিক্ষা নিতে কোনো অসুবিধা নেই।’ তিনি আরও জানালেন, এখানে শুধুই নারী শিক্ষকদের রাখা হয় এবং পর্দা করা অত্যাবশ্যক।
কিন্তু স্থানীয় সূত্র জানায়, তালেবানরা পাঠ্যক্রম থেকে কলা ও নাগরিক শিক্ষা বাদ দিয়ে দিয়েছে এবং সে স্থানে ইসলামি বিষয় ঢুকিয়েছে। এছাড়া তারা জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমই অনুসরণ করে।
কিন্তু তালেবানরা কি তাহলে নিজের কন্যাদেরও বিদ্যালয়ে পাঠায়? জবাবে সালাহউদ্দিন বললেন, ‘আমার মেয়ে এখনো অনেক ছোট। সে বড় হলে আমি তাকে মাদ্রাসায় পাঠাব, যেখানে হিজাব ও শরিয়া মানা হয়।’
বিদ্যালয়ের কর্মীদের বেতন সরকার দিলেও এর মূল দায়িত্বে রয়েছে তালেবান। পুরো দেশের মধ্যে এটি একটি হাইব্রিড প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত নিকটস্থ এক ক্লিনিকে গিয়েও দেখা গেল প্রায় একই চিত্র। নারীরা সেখানে কাজ করতে পারেন, তবে রাতের বেলা একজন পুরুষ সঙ্গী থাকা অত্যাবশ্যক। নারী ও পুরুষ রোগীদের আলাদা রাখা হয়। তবে গর্ভনিরোধ ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক তথ্য সেখানে দেওয়া হয়।
তালেবানরা অবশ্যই চেয়েছিল আমাদেরকে তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে। বিদ্যালয়গামী মেয়েদের দলের পাশ দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি যাচ্ছিল, হাজি হেকমত উল্লাসিত হয়ে তা দেখালেন। আমাদের প্রত্যাশার বিপরীত চিত্র দেখাতে পেরে তাকে বেশ গর্বিত মনে হচ্ছিল। তবু নারীদের ব্যাপারে তালেবান দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়। দলটিতে কোনো নারী নেতৃত্ব নেই এবং ১৯৯০ সাল থেকে তারা নারীদের বাইরে কাজ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
বালখ অঞ্চলের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেল, সেখানে অনেক নারীই বাইরে বেরিয়েছেন, সবার পরনে আপাদমস্তক ঢাকা বোরকাও নেই। তবে স্থানীয় বাজারে কোনো নারীকে পাওয়া গেল না। হাজি হেকমতের দাবি, নারীদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু রক্ষণশীল পরিবার বলে সাধারণত কোনো নারী বাজারে আসেন না।
আমরা পুরো সময়টাই তালেবান সদস্যদের সঙ্গে ছিলাম। স্থানীয় যার সঙ্গেই কথা বলেছি, তিনিই তালেবানদের প্রতি নিজেদের সমর্থন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, তালেবানরা তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। একজন বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, ‘সরকার নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকাকালে আমাদের লোকজনকে জেলে ঢোকানো হতো এবং মুক্তির জন্য ঘুষ চাওয়া হতো। তখন আমাদের ভোগান্তির সীমা ছিল না; তবে এখন ভালো আছি।’
তালেবানদের অতি রক্ষণশীল মনোভাবের সঙ্গে এসব গ্রাম্য এলাকার মানুষের সংঘর্ষ খানিকটা কমই ঘটে। কিন্তু শহরগুলোতে তরুণ সমাজ বিগত দুই দশক ধরে যে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, তা তালেবান ক্ষমতা ও তাদের ১৯৯০ সালের ইসলামি আমিরাতের নিয়মের মাধ্যমে বিনষ্ট হতে পারে বলে জনসাধারণ ভীত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা পরে আমাদের জানান, তালেবানরা আমাদের সাক্ষাৎকারে যেমন দাবি করেছে, তারা এরচেয়ে অনেক বেশি কড়া। গ্রামের মানুষজনকে প্রায়ই দাড়ি শেভ করা বা গান শোনার অভিযোগে চড়-থাপ্পড় মারা হয়। ছোটখাট বিষয়েও তারা মারধর করে এবং মানুষের তাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সাধারণ মানুষ তালেবানদের ভয় পায় বলে তিনি জানান।
হাজি হেকমত ১৯৯০ সাল থেকে তালেবানদের সঙ্গে আছেন। তরুণ সদস্যরা যখন হাসিমুখে সেলফি তুলছে, হাজি হেকমত তখন পাগড়ির কাপড়ে মুখ ঢেকে আমাদের ক্যামেরার সামনে এলেন। পরে তার চেহারার ছবি তুলতে দিলেন; তবে জানালেন, মুখ ঢেকে আসাটা পুরনো অভ্যাস। প্রসঙ্গত, তালেবানদের আগের শাসনামলে ছবি তোলা নিষিদ্ধ ছিল।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তালেবানরা কি তখন কোনো ভুল করেছিল? তারা কি আবারও আগের মতোই আচরণ করবে?’
উত্তরে হাজি হেকমত বললেন, ‘আগের তালেবান আর এখনকার তালেবান একই; কিছুই বদলায়নি। কিন্তু কর্মীদের পরিবর্তন ঘটেছে অবশ্যই। কেউ কেউ বেশি কঠোর, আবার কেউ শান্ত। এটাই স্বাভাবিক।’
তালেবানরা নিজেদের ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ ধারণাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কিছু বিশ্লেষক একে কঠোর ও সহনীয়দের মধ্যে আন্তঃকলহ বন্ধ রাখার উপায় হিসেবে দেখছেন। তারা কি নিজেদের মধ্যেই দুটি আলাদা মতবাদ মেনে নিতে পারবেন? ক্ষমতায় চলে আসাই তাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে তখন।
দুপুরের খাবার খেতে খেতেই আমরা অন্তত চারটি আলাদা বিমান হামলার শব্দ শুনতে পেলাম। তবে হাজি হেকমতকে নির্বিকার মনে হলো। তিনি বললেন, ‘এগুলো অনেক দূরে হচ্ছে; চিন্তার কিছু নেই।’
এতগুলো বছর ধরে মূলত আমেরিকানদের দেওয়া বিমান সুবিধা তালেবানদের থামিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গত বছর তালেবানদের সঙ্গে এক চুক্তির পর থেকে সম্প্রতি আমেরিকা নিজেদের সেনা কার্যক্রম ব্যাপক হারে সরিয়ে নিয়েছে। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তালেবানরা হয়তো দেশজুড়ে সেনানিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।
হাজি হেকমত আফগান সরকারকে দুর্নীতিবাজ ও ‘ইসলামি নয়’ বলে বিদ্রূপ করলেন। তার মতো মানুষ কিভাবে দেশের অন্যদের সঙ্গে মিলে চলবেন, তা একটি দুরূহ ব্যাপার হয়েই দাঁড়াবে।
‘এটাই জিহাদ। এটা উপাসনা। আমরা ক্ষমতার লোভে এই উপাসনা করি না, বরং আল্লাহর জন্য ও তার আইনের জন্য করি। আমরা দেশে শরিয়া আনতে লড়াই করছি। আমাদের পথে যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, আমরাও তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব,’ বললেন হাজি হেকমত।
বিবিসি থেকে অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া