দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও পবিত্র রমজানের মোবারকবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশ-বিদেশে যে যেখানেই আছেন, সবাইকে জানাই ১৪২৮ বঙ্গাব্দের আন্তরিক শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ আবাহনের দিন। এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী এই গান গেয়ে আজ আমরা আবাহন করব নতুন বছরকে। একইসঙ্গে শুরু হয়েছে মুসলমানদের পবিত্র সিয়াম সাধনার মাস, মাহে রমজান। আমি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে মাহে রমজানের মোবারকবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে সময় চলে যায়। করোনা মহামারির মধ্যেই আমরা এক বছরের বেশি সময় পার করলাম। গত বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহের (৮ মার্চ) দিকে আমাদের দেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। নানা আশঙ্কা আর আতঙ্ক গ্রাস করেছিল আমাদের। সেসব মোকাবিলা করেই আমাদের টিকে থাকতে হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এরই মধ্যে করোনার থাবায় আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক প্রিয় ও আপনজনকে। আমি সবার রুহের মাগফিরাত এবং আত্মার শান্তি কামনা করছি। স্বজনহারা পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। আবহমানকাল ধরে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন ছিল বর্ষবরণের মূল অনুষঙ্গ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আগের বছরের দেনা-পাওনা আদায়ের জন্য আয়োজন করতেন হালখাতা উৎসবের। গ্রামীণ পরিবারগুলো মেলা থেকে সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র কিনে রাখতেন। গৃহস্থ বাড়িতে রান্না হতো সাধ্যমতো উন্নতমানের খাবারের। ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ৮০-এর দশকে পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহির্প্রকাশ ঘটতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘মূলত, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনসমূহের কর্মী-সমর্থকদের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলেই আজকের এই অবস্থান। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি জনগোষ্ঠী বসবাস করেন, সেখানেই বাঙালির হাজার বছরের লোক-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে বর্ষবরণসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। আর পৃথিবীজুড়ে তৈরি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছরের মতো এ বছরও আমরা বাইরে কোনো অনুষ্ঠান করতে পারছি না। কারণ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ নতুন করে আঘাত হেনেছে সারাদেশে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের করোনাভাইরাস আরও মরণঘাতী হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। পয়লা বৈশাখের আনন্দ তাই গত বছরের মতো এবারও ঘরে বসেই উপভোগ করব আমরা। টেলিভিশন চ্যানেলসহ নানা ডিজিটাল মাধ্যমে অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হবে। সে সব অনুষ্ঠান উপভোগ ছাড়াও আমরা নিজেরাও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘরোয়া পরিবেশে আনন্দ উপভোগ করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘অতীতের সব জঞ্জাল-গ্লানি ধুয়ে-মুছে আমরা নিজেদের পরিশুদ্ধ করব। দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাব সামনের দিকে। গড়ব আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ- এই হোক এবারের নতুন বছরের শপথ।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত বছর করোনাভাইরাস আঘাত হানার পর আমাদের অনেক বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই মহামারি প্রতিরোধে যেহেতু মানুষের সঙ্গনিরোধ অন্যতম উপায়, সে জন্য আমাদের এমন কিছু পদক্ষেপ করতে হয়েছে যার ফলে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর প্রভাব পড়েছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘গত সপ্তাহে দ্বিতীয় ঢেউ প্রবল আকার ধারণ করলে মানুষের চলাচলের ওপর আমাদের কিছু কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়। আপনারা দেখেছেন, কোনোভাবেই সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাই আমাদের আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। আমি জানি, এর ফলে অনেকেরই জীবন-জীবিকায় অসুবিধা হবে। কিন্তু আমাদের সবাকেই মনে রাখতে হবে- মানুষের জীবন সর্বাগ্রে। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর আমরা একটানা ৬২ দিন সাধারণ ছুটি বলবৎ করেছিলাম। আমরা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারিনি। বিদেশের সঙ্গে চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। এই অবস্থা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের যেখানেই এই মরণঘাতী ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে, সেখানেই এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতি, মানুষের জীবন-জীবিকা যাতে সম্পূর্ণ ভেঙে না পড়ে সেদিকে আমরা কঠোর দৃষ্টি রাখছি। সবার সহযোগিতায় আমরা বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলাম। এর ফলে গত বছর করোনাভাইরাস মহামারিজনিত প্রভাব আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি।’