বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো চীনেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে গেছে। ফলে হুটহাট বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত ঠেকাতে কিছু দিন আগে নতুন একটি আইন করেছে চীন, যেখানে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ৩০ দিনের একটি সময় দেওয়া হচ্ছে।
তবে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, নতুন এই আইন নারীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। কারণ, কেউ কেউ মনে করছেন এ আইনের ফলে দেশটিতে নারীদের বিচ্ছেদ চাওয়া আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেছে। ফলে এই আইনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে দেশটিতে।
চীনের সিভিল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নতুন এই আইন কার্যকর হওয়ার আগে পুরোনো আইনেই বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে ২০২০ সালের শেষ তিন মাসে ১০ লাখেরও বেশি দম্পতি বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এ সংখ্যা ২০১৯ সালের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি।
নারীবাদী লেখক জিয়াও মেইলি নতুন এ আইনকে এক ধাপ পেছনে যাওযার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বলছেন, এ আইন নারীদের মুক্তভাবে কোনো বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি টানার অধিকার হরণ করবে। তিনি আরও বলছেন, বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে দু’পক্ষেরই সম্মতি প্রয়োজন। কোনো ‘এক পক্ষ’ যদি বিচ্ছেদ চেয়ে বসে তবে সেটি হয়ে যাওয়াই উচিৎ। আর এই ‘এক পক্ষ’ বেশিরভাগ সময় নারীই হন।
চীনের সুপ্রিম পিপল কোর্টের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের চীনের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশেরই প্রথম পক্ষ ছিলেন নারী।
বিচ্ছেদের জন্য নতুন এই আইন ছাড়াও আরও যেসব ঘটনাকে বাধা মনে করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্য, সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য এবং ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে এক বিচ্ছেদের শুনানিতে পাঁচ বছরের সাংসারিক জীবনে করা সকল ঘরোয়া কাজের বেতন হিসেবে চীনা মুদ্রায় এক নারীকে ৫০ হাজার ইউয়ান (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ লাখ ৫৩ হাজার টাকা) পরিশোধ করার আদেশ দেয় দেশটির একটি আদালত। পাঁচ বছর বিনা বেতনে ঘরের কাজ করার ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে এই অর্থ দেওয়া হচ্ছে বলে রায়ে জানিয়েছেন আদালত। এ রায়ের পর সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে অর্থনৈতিকভাবে এখন আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছেন চীনের নারীরা। যার ফলে দেখা যাচ্ছে অসুখি দাম্পত্যজীবন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তারা এখন আগের চেয়ে কম আগ্রহী।
তবে বিচ্ছেদবিরোধী সামাজিক চাপ এখনও রয়ে গেছে চীনা সমাজে। পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবদের তরফ থেকে বিচ্ছেদের বিষয়ে সবসময়ই নিরুৎসাহিত করা হয়। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চীনা আদালতগুলোরও বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার একটা প্রবণতা আছে। বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর নারীদের এখনও সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়।
ভোগান্তি এবং নির্যাতনের প্রমাণও অনেক সময় বিচ্ছেদের নিশ্চয়তা দেয় না চীনে। এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালে। লিউ নামে এক নারীকে তার স্বামী পেটাচ্ছেন এমন দৃশ্য সিকিউরিটি ক্যামেরায় ধরা পড়লেও ওই নারীর বিচ্ছেদের আবেদন নাকচ করে দেন আদালত। পরে ওই ভিডিওটি লিউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে দিলে সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদল করে আদালত।
চীনের সিভিল অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো অবশ্য বলছে, দেশটিতে নতুন যে আইন করা হয়েছে তা পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। তারপরও আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের এই প্রক্রিয়া অনেক নারীর জন্যই অনেক দীর্ঘমেয়াদি হয়।
মা দানইয়াং নামে বেইজিংয়ের এক আইনজীবী বলছেন, নতুন এই আইন তার মক্কেলদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
নতুন এই আইনের পক্ষেও কথা বলছেন অনেকে। তারা বলছেন, বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটা আসলে অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার এ রকম সময় থাকার নিয়ম বহু দেশেই চালু রয়েছে।
চীনে যে শুধু বিবাহবিচ্ছেদই বাড়ছে তা নয়, এরসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের বিয়ের প্রতি অনীহাও বাড়ছে, আর কমছে জন্মাহার। দেশটিতে কয়েক দশক ধরে চলেছে ‘এক শিশু নীতি।’ ২০১৫ সালে সেটি বাতিল করা হয়। তবে কেবল এই একটি পরিবর্তন দেশটিতে বড় কোনো বদল এখনও এনে দিতে পারেনি।
বিবাহবিচ্ছেদ ঠেকাতে চীনে নতুন যে আইন করা হয়েছে তা অনেককে বিয়ে করতেই নিরুৎসাহিত করবে বলেও মনে করেন অনেকে। কারণ, এখনকার তরুণীরা লিঙ্গ সমতার বিষয়ে এখন অনেক বেশি সচেতন।
সূত্র : এনবিসি নিউজ।