উনিশ শতকে বাঙলী সমাজে নারীর জীবন যখন ছিল খুবই পশ্চাদপদ এবং বহু প্রতিকূলতায় জর্জরিত, তখন সবরকম সামাজিক বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন এক বাঙালি নারী, যার নাম কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই শুধু নয়, উনবিংশ শতাব্দীতে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দু’জন নারী স্নাতকের একজন।
ব্রিটিশ শাসিত দেশগুলো থেকে প্রথম যে দু’জন নারী গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তারা হলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (তখন বসু) এবং চন্দ্রমুখী বসু। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে তারা দু’জন স্নাতক হন।
কাদম্বিনী স্নাতক পাশ করার পর ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনিই ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পেশাজীবী নারী চিকিৎসক।
কিন্তু কাদম্বিনীর এই ইতিহাস গড়ার পেছনে রয়েছে কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস। কিশোরী বয়স থেকে প্রতিপদে রক্ষণশীল সমাজ তাকে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দিয়েছে, হেয় করেছে, এমনকি ডাক্তার হওয়ার পরে তিনি যখন রাতে রোগী দেখতে যেতেন তখন এক পত্রিকায় তাকে ‘বেশ্যা’ বলেও কুৎসা ছড়ানো হয়েছে।
অনেক রোগী চিকিৎসা নেয়ার পরও তাকে চিকিৎসকের মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেছে।
কে এই কাদম্বিনী?
কাদম্বিনী বসুর জন্ম ১৮৬১ সালে। বরিশালের চাঁদসি গ্রামে ছিল তাদের পৈতৃক বাসস্থান। বাবা ব্রজকিশোর বসু চাকরি সূত্রে থাকতেন বিহারের ভাগলপুরে, যেখানে তিনি ভাগলপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেখানেই জন্ম কাদিম্বিনীর।
ব্রজকিশোর ভাগলপুরে নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং ভারতের প্রথম মহিলা সমিতি তিনিই স্থাপন করেন।
ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক পরিবেশের কারণে কাদম্বিনীর পড়াশোনায় ছিল প্রবল আগ্রহ। বাবা তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ১৪ বছর বয়সে ভর্তি করে দেন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় নামে একটি বোর্ডিং স্কুলে।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন বরুণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ওই কিশোর বয়সেই পরিবারের বাইরে থেকে বড় হয়ে ওঠা কাদম্বিনীর চরিত্রের ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল।
নারী শিক্ষার গুরুত্ব তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন তখন থেকেই। তার স্কুলের শিক্ষক দ্বারকানাথ ছিলেন নারী শিক্ষার একজন প্রবক্তা। দ্বারকানাথের কাজ কাদম্বিনীর কিশোরী মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যা পরে গভীর প্রেমে রূপ নেয়।
যে স্কুলে কাদম্বিনী পড়তেন সেটি বছর দুয়েকের মধ্যে উঠে যাওয়ার উপক্রম হলে স্কুলটিকে কলকাতায় মেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেথুন স্কুলের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। কালক্রমে ওই স্কুল থেকে এন্ট্রাস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেন মাত্র দু’জন ছাত্রী, যাদের একজন ছিলেন কাদম্বিনী।
অন্য ছাত্রীটির পারিবারিক কারণে আর পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন একমাত্র কাদম্বিনী।
মেয়েদের উচ্চশিক্ষার কোনো চল সে সময় ছিল না, ফলে মেয়েদের পড়ার জন্য কোনো কলেজই ছিল না। বরুন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, কাদম্বিনীর লেখাপড়ার জন্যই বেথুন স্কুল প্রথমে এফ.এ. (ফার্স্ট আর্টস- বর্তমানের উচ্চ মাধ্যমিক সমমান) ও পরে বি.এ. ক্লাস চালু করে।
বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তে বাংলায় সাড়া পড়ে যায়।
খ্রিস্টান স্কুল থেকে প্রাইভেটে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ছাত্রী চন্দ্রমুখী বসু এসে তার সাথে যোগ দেন বেথুন কলেজে বিএ পড়তে এবং ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে দু’জনে বিএ পাশ করে ইতিহাস গড়েন।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলির প্রপৌত্র রাজীব গাঙ্গুলি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার মেধার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছিল।
‘মেয়েদের শিক্ষার জন্য যারা সে সময় আন্দোলন করছিলেন কাদম্বিনীর কাছে একদিকে তাদের বিরাট একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, অন্যদিকে কাদম্বিনীর নিজের মধ্যেও একটা একরোখা ভাব ছিল- আমাকে এগোতেই হবে।’
কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জীবন সংগ্রাম নিয়ে কলকাতায় প্রচারিত সিরিয়ালের লেখিকা শর্বরী ঘোষাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কাদম্বিনীর জীবন কাহিনী মেয়েদের জন্য অসামান্য অনুপ্রেরণার ইতিহাস।
‘এই মেয়েটি শিক্ষাজীবনে শুধু নিজেই এগোয়নি, নারীর জন্য শিক্ষাব্যবস্থাও তার কারণেই ধাপে ধাপে এগিয়েছে। তার জন্যই বেথুনের মত নার্সারি স্কুলে এন্ট্রাস ক্লাস চালু হয়েছে, বেথুন কলেজিয়েট স্কুল হয়েছে, কারণ তিনি পড়তে চেয়েছেন এফএ। তিনি স্নাতক পড়বেন, বেথুন স্কুলকে তাই কলেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তার হাত ধরেই বাংলায় নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথ তৈরি হয়েছে,’ বলেছেন শর্বরী ঘোষাল।
রাজীব গাঙ্গুলি বলছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই দু’জন নারীর ডিগ্রি নেয়া দেখতে কত লোক যে এসেছিল।
‘ইংল্যান্ডেও তখন নারী শিক্ষার প্রসার সবে ঘটতে শুরু করেছে। কাজেই ইংল্যান্ডের বাইরে এই দুই নারীর সমাবর্তনে ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছিলেন ভারতে ঔপনিবেশিক শাসক সমাজের বহু মানুষ।’
তবে গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, সবাই যে উৎসাহ নিয়ে তাদের অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন তা নয়, অনেক রক্ষণশীল মানুষ এসেছিলেন দুই নারীর স্নাতক উপাধি নেয়া ভণ্ডুল করতে। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
উচ্চশিক্ষার জন্য লড়াই
কাদম্বিনীর জন্য উচ্চ শিক্ষার পথ ছিল কঠিন সংগ্রামের। স্নাতক হওয়ার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মেডিক্যালে পড়বেন। আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়।
সমাজেও নানাভাবে ব্যঙ্গবিদ্রূপের শিকার হলেন তিনি। নারীরা চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়বে এটা সেসময় সমাজ ভাবতেও পারত না। বিশেষ করে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে মেয়েদের সামনে বিস্তারিত আলোচনা ও পাঠদান তখন শিক্ষকদের জন্য ছিল খুবই অস্বস্তিকর। আর ক্লাসে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
তার প্রথম আবেদন নাকচ হয়ে যায় তিনি তখনও স্নাতক হননি সেই যুক্তিতে। কিন্তু স্নাতক হওয়ার পর কাদম্বিনী যখন দ্বিতীয়বার চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার আবেদন জানালেন, তখন আপত্তি জানাল মেডিক্যাল কাউন্সিল, পাশাপাশি তার মেডিক্যাল কলেজে ঢোকা বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগল কলেজের শিক্ষকদেরই একাংশ।
বহু প্রতিরোধের দেয়াল ডিঙিয়ে এবং রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত কাদম্বিনী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেন মূলত সে সময় বাংলার লেফটন্যান্ট গর্ভনর রিভার্স টমসনের আগ্রহ ও ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের কারণে।
তার হস্তক্ষেপে মেডিক্যঅল কলেজ কাউন্সিল কাদম্বিনীকে ডাক্তারিতে ভর্তি করতে বাধ্য হয়।
দ্য ওম্যান্স হেরাল্ড নামে ইংরেজি একটি পত্রিকায় অগাস্ট ১৮৯৩ সালে কাদম্বিনীর শিক্ষাজীবনের সংগ্রাম নিয়ে এক নিবন্ধে লেখা হয়, কাদম্বিনীকে ডাক্তারি না পড়ার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল ডাক্তারি পড়তে গেলে পুরুষদের কাছ থেকে তাকে অপমান সহ্য করতে হতে পারে।
পত্রিকায় লেখা হয়, কাদম্বিনী বলেছিলেন তিনি সবরকম অপমান সহ্য করতে প্রস্তুত আছেন। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী এক বছর ক্লাসে তিনি ২০০ জন পুরুষের মধ্যে ছিলেন একমাত্র নারী।
গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, তার ডাক্তারি পড়াকে রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ একেবারেই মেনে নিতে চায়নি। সমাজে যারা উদারমনস্ক ও নারী শিক্ষার সমর্থক ছিলেন, এমনকি তারাও চাননি একজন মেয়ে ডাক্তারি পড়ুক।
‘এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কাদম্বিনীর এতো বড় অর্জনে নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি চন্দ্রমুখীকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন, উপহারে পুরস্কৃত করেছিলেন, কিন্তু কাদম্বিনীর সাফল্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তার উচ্চশিক্ষার তিনি বিরোধিতা করেননি, কিন্তু বিদ্যাসাগরের বিস্ময়কর নীরবতা থেকে মনে হয়েছে কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়াকে তিনি সমর্থন করতে পারছেন না।’
‘মেয়েদের বিজ্ঞান পড়া, সর্বোপরি ডাক্তারি পড়ে সক্রিয় পেশাজীবী জীবন বেছে নেয়াকে কি তিনি সমর্থন করতে পারেননি। না হলে এমন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন কেন?’ মন্তব্য করেছেন বরুণ চট্টোপাধ্যায়।
চরিত্রের ওপর আঘাত
সে সময়কার একটি পত্রিকা বঙ্গনিবাসীতে একটি লেখায় তার পেশা নিয়ে তির্যক ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছিল। একটি ঘটনার খবর প্রসঙ্গে তার রাতে রোগী দেখতে যাওয়ার বিষয়ে কটাক্ষ করে তাকে ‘নটী’ উল্লেখ করে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা হয় ‘তিনি কি ডাক্তারি করেন না কি বেশ্যাবৃত্তি করেন?’
তবে তেজস্বিনী নারী কাদম্বিনী পত্রিকার সম্পাদককে ছেড়ে দেননি। তিনি ও তার স্বামী দ্বারকানাথ আদালতে অভিযোগ জানান। বিচারে সম্পাদকের ছয় মাসের জেল ও জরিমানা হয় এবং মানহানির ক্ষতিপূরণ হিসাবে কাদম্বিনীকে দেয়া হয় তিন হাজার টাকা। একজন নারীর এই সাহস সমাজে রীতিমত তোলপাড় ফেলে দেয়।
মেডিক্যাল কলেজের একজন অতি রক্ষণশীল বাঙালি অধ্যাপক যিনি গোড়া থেকেই কাদম্বিনীর ডাক্তারির পড়ার বিষয়ে খোলাখুলি প্রতিবাদ করেছিলেন, তিনি কাদম্বিনীকে পরীক্ষা পাশের জন্য প্রয়োজনীয় নম্বর দেননি বলে কথিত আছে।
বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, কাদম্বিনীকে এক নম্বর কম দিয়ে পাশ না করানোর বিষয়টি নিয়ে সেনেটের বৈঠকে তখন যে আলোচনা হয়েছিল, তার দালিলিক প্রমাণও রয়েছে।
ব্রিটিশ একজন চিকিৎসক ডা. জে এম কোটস যিনি তখন ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং মেডিসিনের অধ্যাপক, তিনি বুঝেছিলেন যে, কাদম্বিনীর সাথে অন্যায় হচ্ছে। তার উদ্যোগে সিন্ডিকেটে আলোচনার মাধ্যমে কাদম্বিনীকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ বা এলএমএসের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালে।
কিন্তু দু’বছর এলএমএস পড়ার পরে ফাইনালে ফের কাদম্বিনীকে অকৃতকার্য দেখানো হয়।
এরপর অধ্যক্ষ কোটস নিজের অধিকার প্রয়োগ করে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডি্যোল কলেজ’ বা জিবিএমসি উপাধি দেন, যার ফলে ডাক্তার হিসাবে প্র্যাকটিস করার ছাড়পত্র পান কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
পেশা জীবনের সংগ্রাম
ইডেন হাসপাতালে তাকে কাজের সুযোগ করে দেন ডা. কোটস। কিন্তু সেখানে ডাক্তার হিসাবে তাকে গণ্য করা হত না, সেখানে তাকে নার্সের মর্যাদা দেয়া হতো। রোগ নির্ণয় বা অস্ত্রোপচার করতে দেয়া হতো না।
এরপর লেডি ডাফরিন হাসপাতালে তার চিকিৎসার সুযোগ হয় ১৮৯০ সালে। সেই কাজ পেতে কাদম্বিনীর জন্য তদ্বির করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল।
রাজীব গাঙ্গুলি বলছেন, ‘কাদম্বিনীর কথা কীভাবে পৌঁছেছিল ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কাছে। তিনি লেডি ডাফরিনকে লিখে কাদম্বিনীকে সেখানে কাজ দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই হাসপাতালে তখন ইংল্যান্ডের ডাক্তারদেরই প্রতিপত্তি। কাজ করার সুযোগ পাননি কাদম্বিনী।’
কাদম্বিনী ১৮৮৮ থেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রাইভেটে রোগী দেখতেন। ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রাতবিরেতে রোগী দেখতে যেতেন, প্রাইভেট চেম্বার খুলেছিলেন এবং নিয়মিত অস্ত্রোপচারও করতেন, বলেছেন রাজীব গাঙ্গুলি।
কিন্তু তার ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে, তার যোগ্যতা নিয়ে বিরোধীরা প্রতি পদক্ষেপে তাকে বিদ্রূপ করতেন, তাকে চিকিৎসকের দায়িত্ব দেয়ার প্রতিবাদ করতেন, এবং বলতেন তিনি একজন ধাত্রী বা নার্স, আদতে কোনো চিকিৎসকই নন।
বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, এই বিষয়টি কাদম্বিনী মেনে নিতে পারছিলেন না। এ সময়ই বিদেশে গিয়ে তিনি ডাক্তারি ডিপ্লোমা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এ ব্যাপারে তার পেছনে ছিলেন তার স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি।
স্নাতক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার থেকে বয়সে অনেক বড়, বিপত্নীক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিকে কাদম্বিনী বিয়ে করেছিলেন, যিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক, এবং নারী শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম একজন কর্ণধার।
তাদের এই বিয়ে নিয়েও সমাজে নানা কথাবার্তা উঠেছিল, তৈরি হয়েছিল তুমুল আলোড়ন।
আট সন্তানকে কলকাতায় রেখে স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কাদম্বিনী ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডে যান চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা নেয়ার জন্য। এক বিদেশি মহিলার সঙ্গিনী হয়ে জাহাজে একা বিদেশযাত্রা করেন।
ক্লাস করতেন তিনি স্কটল্যান্ডে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে স্কটিশ কলেজের তিনটি ডিপ্লোমা অর্জন করে তিনি দেশে ফিরে যান।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলির রোগীদের সিংহভাগ ছিলেন গরীব ও প্রান্তিক মুসলিম ও নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা।
‘ধনী পরিবারের, রাজপরিবারের মেয়েদের চিকিৎসা করে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। নেপালের রাজপরিবারের চিকিৎসা করে প্রচুর অর্থ তিনি আয় করেছিলেন। প্রচুর উপহার পেয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে। গরীব ও সমাজের অবহেলিত সম্প্রদায়ের মানুষের চিকিৎসাই ছিল তার জীবনের একটা বড় ব্রত,’ বলছিলেন গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায়।
তবে শর্বরী গাঙ্গুলি বলেছেন, এত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ডাক্তার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পরেও কাদম্বিনীকে সমাজ এমনকি একজন চিকিৎসকের যোগ্য সম্মানও দেয়নি।
‘সন্তান প্রসব করানোর জন্য তিনি যখন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়িতেও গেছেন, তাকে ‘দাই’ বলে ডাকা হয়েছে। খেতে দিয়ে নিজের থালাবাসন তাকে ধুয়ে দিয়ে যেতে বলা হয়েছে।’
কদিম্বিনীর প্রপৌত্র রাজীব গাঙ্গুলি বলছিলেন, ‘ঠাকুমার কাছে শুনেছি, কঠিন কেসে সফলভাবে প্রসব বা অস্ত্রোপচারের পর কাদম্বিনীকে যখন খেতে দেয়া হয়েছে, তাকে ঘরের ভেতর আসন দেয়া হয়নি। এমন একটা বাড়িতে কাদম্বিনীর সাথে গিয়েছিলেন আমার ঠাকুমা।’
‘কাদম্বিনীকে বাইরে বসে খেতে বলেছিল, থালাবাটি ধুয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে যেতে বলেছিল। অপমানে আমার ঠাকুমার চোখে জল এসেছিল। তখন তিনি ইংল্যান্ড ফেরত।’
রাজীব গাঙ্গুলি বলেন, ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পেশাজীবী নারী চিকিৎসককে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুরুষশাসিত সমাজে আত্মমর্যাদা পেতে লড়াই চালিয়ে গেছেন, নিজের যোগ্যতা প্রমাণে শেষ দিন পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে গেছেন।
আনন্দীবাঈ যোশী নামে আরেকজন ভারতীয় নারী একই বছর অর্থাৎ ১৮৮৬ সালে ডাক্তারি পাশ করেন আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ থেকে। বম্বের মেয়ে আনন্দীবাঈকে তার স্বামী ডাক্তারি পড়তে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ভারতে ফেরেন, প্র্যাকটিস করার সুযোগ তার আর হয়নি। পুনায় ২১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সূত্র : বিবিসি