করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম ঊর্দ্ধমুখি ছিলো। সময়ের ব্যবধানে অনেক পণ্যের দাম কমে এসেছে ক্রয় সীমার মধ্যে। তবে অতি ‘প্রয়োজনীয়’ নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ভোজ্যতেলের দাম ইতোমধ্যে ক্রয় সীমা অতিক্রম করেছে।
ভোজ্যতেলের এই উর্ধমুখি দাম গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে মনে করছেন ক্রেতা-বিক্রেতাসহ খাত সংশ্লিষ্টরা। যাকে রীতিমতো ক্রেতার নাভিশ্বাসের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন তেল ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায়, যা তিন মাস আগেও ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। এর বাইরে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল কোম্পানিভেদে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তারা বলছেন, করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কম। এছাড়া চীন বেশি পরিমাণে তেল কিনে রেখেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ধারণা, শীতের কারণে পাম তেল জমে থাকায় তা বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। এ কারণে সয়াবিনের উপর চাপ পড়ছে। এটাও দাম বাড়ার একটি কারণ। আগামী মার্চ পর্যন্ত ভোজ্যতেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলেও মনে করছেন তারা।
রাজধানীর কাওরান বাজারের ব্যবসাসী আলতাফ হোসেন বলেন, গত ৪-৫ মাসের মধ্যে ভোজ্য তেলের দাম এই মাসে এসে সর্বোচ্চ। পাইকাররা আমাদের বলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি। এছাড়া শীতে পাম তেল জমে থাকায় সয়াবিন তেলের উপর চাপ পড়ছে। এতে দাম বেড়েছে।
যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকার ভাই ভাই স্টোরের মালিক নুরুজ্জামান বলেন, শীত গেলে দাম পড়ে যেতে পারে। তবে দাম বাড়লেও সরবরাহ কম নয় বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় হওয়ায় দেশের বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে আমাদেরও দাম কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলেও সরকারি পদক্ষেপে দাম কমানো যেতে পারে। এ জন্য ভ্যাট ও ট্যাক্স কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্যতেলের ওপর শুধু আমদানি পর্যায়েই ভ্যাট নেয়ার জন্য আবেদন করেছিল।
সংগঠনটি আবেদনে জানায়, বর্তমানে ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন, পাম ও পাম অলিন তেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি), উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং বিক্রয় ও সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট রয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এ সময় খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৯১-৯৩ টাকা লিটার। এবার সয়াবিনের মতো পাম তেলের দামও বেড়েছে। পাইকারিতে পাম সুপার বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ টাকা মণ, যা গত সপ্তাহে ১০০ টাকা কম ছিল। খুচরায় পাম সুপার বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা লিটার।
পরিবাগ বাজারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন হালিমুর রহমান। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বাজারে তেলের সরবরাহ কিছুটা কম। ফলে দাম বাড়তি। আমার কিছু মজুত করা মাল থাকায় ১২৮ টাকায় বিক্রি করতে পারছি।
তবে দাম বাড়লেও তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেন পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা। তিনি বলেন, তেলের বাজার ভয়াবহ খারাপ। দাম বাড়ছেই। ২৫ বছরের মধ্যে তেলের বাজারে এত দাম উঠল।
গোলাম মওলা বলেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আমদানির বড় বাজার। এসব দেশে করোনার কারণে উৎপাদন কম। এ ছাড়া চীন এবার ব্যাপক হারে তেল কিনেছে। ফলে সংকটের মধ্যে আরও সংকট তৈরি হয়েছে। মিলমালিক ও সরকার পদক্ষেপ নিলে দামের রাশ টেনে ধরা যেতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে প্রতিবছর ২.২ থেকে ২.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়। দেশে তেলের চাহিদা ২.২ মিলিয়ন টন। মোট আমদানির মধ্যে সয়াবিনের পরিমাণ ০.৭ থেকে ০.৮ মিলিয়ন টন এবং পাম তেল ১.৪ থেকে ১.৬ মিলিয়ন টন। আর বাকিটা সরিষা, সূর্যমুখী, ধানের তুষ থেকে তৈরি এবং অন্যান্য ভোজ্যতেল।
এদিকে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির এই অবস্থা নিরসনে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটিও করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেলের সাপ্তাহিক বৈঠকে ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
ওই বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোজ্যতেল ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যায়, সেটার প্রভাব পড়ে। জুলাই মাসে প্রতি টন ৭০০ ডলার ছিল, সেটা ১১০০ ডলারের ওপরে উঠেছে, মাঝখানে ১১৯০ ডলারও হয়েছিল। তার মানে ইতোমধ্যে ৭৫ শতাংশের ওপরে দাম বেড়েছে। আমাদের দেশেও দামের প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে কী দাম হওয়া উচিত, সেটা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের রেজাল্ট হলো, কী প্রাইস হলে যৌক্তিক হয়, তার একটা ওয়েআউট করব। দেশীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারের মধ্যে নজরদারি রাখার জন্য একটা কমিটি করা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে একটা চুলচেরা বিশ্লেষণ করার জন্য একটা কমিটি করার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি।
ভোজ্যতেল আমদানিতে আগে এক স্তরে ডিউটি থাকলেও চলতি অর্থবছরে সেটা চার স্তর করা হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানান। হয়রানি ও ঝামেলা এড়ানোর জন্য ডিউটি আবার এক স্তরে নিয়ে আসতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানান ব্যবসায়ীরা।
মন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীরা বলেছেন, চার স্তরে যে ডিউটিটা নেয়া হয় সেটা এক জায়গায় হলেই তাদের জন্য সুবিধা হয়। সেটার ব্যাপারে আমরা এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি, উত্তর আসেনি। এখন আবার চিঠি দেব।
সারা বছর বাজারে ৭০ থেকে ৭২ শতাংশ খোলা ভোজ্যতেল আর বাকিটা প্যাকেটজাত তেল বিক্রি হয় বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়। তেলের মান ও সরবরাহ ব্যবস্থা শৃঙ্খলায় রাখতে আরও বেশি পরিমাণ বোতলজাত তেল বাজারজাত করার চেষ্টা চলছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আরও বেশি বোতলজাত করা গেলে দামের হেরফের কম হবে। শুধু দামের জন্য না, কোয়ালিটির জন্যও বোতলজাত হওয়া জরুরি। শিল্প মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে চেষ্টা করছে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এটা একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে। ৭০ শতাংশ যেন বোতলজাত করা যায়। নকল মাল থেকেও মানুষ রেহাই পাবে।
এদিকে, চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারি-মার্চেও ক্রেতাদের উচ্চমূল্যে ভোজ্যতেল কিনতে হবে বলে ধারনা পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকদের বক্তব্যে। তারা বলছেন, নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিক জুড়েই তেলের বাজার ঊর্দ্ধমুখি থাকবে।
বিষয়টি নিয়ে জার্মানিভিত্তিক বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান অয়েল ওয়ার্ল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও টমাস মিলকে সম্প্রতি একটি অনলাইন সেমিনারে বলেন, সয়াবিনের বাড়তি দামের প্রভাবে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক পর্যন্ত ভোজ্যতেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত ক্রেতাদের চড়া দামেই কিনতে হবে ভোজ্যতেল।