করোনাভাইরাস মহামারি মানুষের জীবনকে যেমন বিপর্যস্ত করেছে তেমনি আচার-আচরণ পাল্টে দিয়েছে অনেক। দেশে ২০২০ সালের মার্চের আগে মানুষ যে জিনিসগুলো নিয়মিত ব্যবহার করতো না এখন সেগুলো হয়েছে নিত্য সঙ্গী। এমন পাঁচটি জিনিস যেগুলো ছাড়া এখন মানুষ ঘরের বাইরে বের হওয়ার কথা চিন্তা করছে না।
মাস্ক
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রথম যে জিনিসটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে সেটা হল মাস্ক। দেশের বড় শহরগুলো বিশেষ করে ঢাকায় প্রায়ই বায়ু দূষণের মাত্রা চরমে পৌঁছালেও আগে মানুষকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি ঘোষণা করার পর মানুষ মাস্ক পরা শুরু করে। ফলে এর বিক্রি যায় বেড়ে। যেসব দোকানে কখনোই মাস্ক পণ্য হিসেবে রাখা হত না সেসব দোকান তো বটেই, এমনকি ওষুধের দোকান, সুপার শপ এমনকি রাস্তার হকাররা এখন মাস্ক বিক্রি করেছে।
চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়েছে। গুলশান এবং খিলগাঁও এর ফার্মেসিগুলো বলছে করোনার আগে মাস্ক তাদের দোকানে নিয়মিত রাখা হত না। সার্জিকাল মাস্ক রাখা হত, যেগুলো শুধুমাত্র মেডিকেলে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে থাকতো। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে যখন এর চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায় তখন চাহিদার যোগান দিতে তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়।
একজন ক্রেতা হাসিবুল হাসান বলছিলেন সার্জিকাল মাস্ক আগে ৫ টাকায় কিনেছি কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর প্রথম কয়েক মাস ৫০ টাকা দিয়ে কিনেছি প্রতি পিস। বাসার সবার জন্য কিনতে কয়েকশ টাকা খরচ হয়েছে। এর এক পর্যায়ে, সচরাচর যেসব দোকান থেকে মাস্ক কিনি, সেখানেও পাওয়া যায়নি। তবে মাস্কের দাম এখন অনেকটা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। মানুষের জীবনে মাস্কের ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার
কয়েক ফোঁটা তরল পদার্থ যেটা হাতে মাখলে হাত জীবাণুমুক্ত হয় এই ধারণাটা হয়ত সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছিল না। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে বার বার হাত ধুতে হবে এই স্বাস্থ্য বিধি মানতে মানুষ সাবান দিয়ে যেমন হাত ধুয়েছে তেমনি এই তরল পদার্থ বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার এখন মানুষের হ্যান্ডব্যাগে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মত স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ মুখে তো বটেই অনেকে নিজের ব্যাগেই রাখছেন হ্যান্ড স্যানিটাইজারের একটি ছোট বোতল।
পিপিই
পিপিই বা পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট এই শব্দগুলোই ছিল মানুষের কাছে একেবারে অপরিচিত। করোনাভাইরাসের সময় স্বাস্থ্য বিধি মানার জন্য ডাক্তার, নার্স এবং স্বাস্থ্য সেবা-দান কর্মীদের এই পিপিই বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার এখন বাধ্যতামূলক।
এর বাইরেও অনেকেই বিশেষ ভাবে তৈরি করা এই পোশাক পরছেন নিজেদের সুরক্ষার জন্য। যেমন দেখা যায় দৈনন্দিন কাজের সূত্রে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি যাদের হতে হচ্ছে, যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা গার্ড, বা বড় বড় দোকানে ক্রেতাদের মুখোমুখি হচ্ছেন যেসব সেলস্ কর্মীরা, তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য পিপিই পরছেন।
করোনাভাইরাসের জীবাণু যাতে করে কোনভাবেই শরীরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য এই বিশেষ ধরণের পোশাক পরা এখন অনেকেই আবশ্যক মনে করছেন। প্রথম দিকে দেখতে কিছুটা অদ্ভুত দেখালেও এখন অনেকের কাছে পরিচিত এই পোশাক।
শরীরে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র
এতদিন জ্বর হলে তবেই বাসায় রাখা ছোট থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপতে অভ্যস্ত ছিল মানুষ। এছাড়া হাসপাতালে থার্মোমিটার ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এখন বাড়ির বাইরে বের হয়ে যেখানেই যাবেন সেখানেই প্রবেশ মুখে দাঁড়াতে হবে আপনার এই তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রের সামনে।
তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আসলে আপনাকে বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। চিকিৎসকরা বলছেন শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬। এর চেয়ে বেশি হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বড় আ্যাপার্টমেন্ট, ব্যাংক, দোকান, মার্কেট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন পিপিই পরে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র হাতে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেই যন্ত্র কপালের কাছাকাছি নিলে শরীরে তাপমাত্রা পরিমাপ করাকে মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে। এতে করে সে নিজেও জানতে পারছে তার শরীরের তাপমাত্রা ঠিক ঐ মুহূর্তে কত।
পালস অক্সিমিটার
পালস অক্সিমিটার, হৃৎস্পন্দন ও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র। ছোট এই যন্ত্রটি ব্যবহার করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। হাতের আঙ্গুলে রাখলে যন্ত্রটির উপর ভেসে ওঠে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা এবং হৃৎস্পন্দন কত। করোনাকালে কারো শ্বাস-কষ্ট হলে এই যন্ত্র ব্যবহার করে নিজেরাই সহজে মেপে নেয়া যায় শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা।
বাংলাদেশ বক্ষ-ব্যাধি ইন্সটিটিউট এবং হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসক ডা. কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলছিলেন, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৪ শতাংশের নিচে নেমে গেলে তাকে অক্সিজেন দিতে হবে। অক্সিমিটার দিয়ে মেপে যদি ৯৪ এর নিচে আসে তাহলে তাকে বাসায় অক্সিজেন দিয়ে পালস বাড়াতে হবে। যদি না বাড়ে সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে নিতে হবে। শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা এর চেয়ে কমে গেলে নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে বলেন তিনি।
বাসায় বা ব্যাগে ছোট এই যন্ত্রটি থাকলে মানুষ নিজেই বুঝতে পারবে কখন অক্সিজেন দিতে হবে, কখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে বা কার আরো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের দরকার হবে।
সূত্র: বিবিসি