ঋতুচক্রে এখন চলছে শীতকাল, বাংলা মাসের হিসেবে পৌষের বিদায়ক্ষণ। বারো মাসে তেরো পার্বনের এই দেশে এই পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে ঘিরে রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পুরান ঢাকার বাসীন্দাদের কাছে যা সাকরাইন উৎসব হিসেবে পরিচিত থাকলেও গ্রাম বাংলায় এখনো এটিকে পৌষ সংক্রান্তিই বলা হয়।
সাকরাইন বা পৌষ সংক্রান্তিকে বাংলাদেশে শীত মৌসুমের বাৎসরিক উদযাপনও বলা যেতে পারে। ঘুড়ি উড়িয়ে, আতশবাজিতে আর হরেক বাহারের পিঠা পুলি খাওয়ার মধ্য দিয়ে যা উদযাপন করে উৎসবপ্রিয় বাঙালিরা। কিন্তু এবছর করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে কিছুটা ভাঁটা পড়বে এই আয়োজনে।
বর্তমানে দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রঙবেরঙ ফানুশে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী শহরের আকাশ। তাই ঢাকাবাসীর কাছে এক কথায় বলা যায় সাকরাইন হচ্ছে এক ধরনের ঘুড়ি উৎসব। তবে মফস্বল বা গ্রাম গঞ্জে ঘটা করে ঘুড়ি না উড়ানো হলেও পিঠা খাওয়ার নিমন্ত্রন পাওয়া যায় এই দিনে অহরহ।
বাংলা ক্যালেন্ডারের নবম মাস পৌষ মাসের শেষ দিনে আয়োজিত হয় যা গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের হিসেবে জানুয়ারি মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে পড়ে। বাংলাদেশে এ দিনটি পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন নামে পরিচিত হলেও ভারতীয়দের কাছে মকর সংক্রান্তি নামেই পরিচিত।
সময়ের সাথে সাথে বদলেছে উদযাপনের ধরণ। বর্তমানে সাকরাইন বা পৌষ সংক্রান্তির আনন্দ উপভোগ করতে হলে আপনাকে যেতে হবে পুরান ঢাকায়। এখনো এই জায়গার বাসীন্দারা আমোদ-ফূর্তির মধ্য দিয়ে উৎসবটি পালন করে থাকেন।
মূলত পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতে বেশি জমজমাট ভাবে উদযাপিত হয় পৌষসংক্রান্তি তথা সাকরাইন। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, লালবাগ ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ছোট, বড় সকলেই মেতে উঠে এ উৎসবে। বিকেল বেলা এই সব এলাকায় আকাশে রঙ বেরঙের ঘুড়ি ওড়ে। ছাদে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। অধিকাংশ সময়ে ভোঁ কাট্টা’র (ঘুড়ি কাটাকাটি) প্রতিযোগীতা চলে। একজন অপরজনের ঘুড়ির সুতা কাটার কসরৎ করে।
নতুন ঢাকার বাসীন্দা আঞ্জুমান ফাহী বলেন, সারাবছর এই দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করি। কখন সাকরাইন আসবে আর আমরা উৎসবে যোগ দেব। সাকরাইনের অনেক আগে থেকেই আমরা ঘুড়ি কেনা, ছাদ সাজানো এসব করে রাখি।
নিজে নতুন ঢাকার বাসীন্দা হলেও প্রতিবছর সাকরাইন উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য পুরান ঢাকায় বান্ধবীর বাসায় চলে আসেন বলে জানান আঞ্জুমান।
আঞ্জুমান বলেন, ‘আমি থাকি নতুন ঢাকায়। কিন্তু সাকরাইনে আমরা বন্ধুরা মিলে পুরান ঢাকায় চলে আসি। কারণ এই উৎসব বছর ঘুরে একবার আসে এবং আমরা এই উৎসবেই সবথেকে বেশি আনন্দ করি। তবে এবছর করোনার কারণে কিছুটা খারাপ লাগছে। হয়তো বিগত বছরের মতো হবে না। তাও আমরা ঘুড়ি উড়াবো, আনন্দ করবো।‘
কথা বলতে বলতে নস্টালজিয়া হয়ে আঞ্জুমান বলেন, ‘ছোটবেলা বাবার সাথে ছাদে গিয়ে ঘুড়ি উড়ানো দেখতাম। নানান রঙের ঘুড়িতে বাসার ছাদ ভরে যেতো। ভোঁ কাট্টা’র প্রতিযোগিতায় কারো ঘুড়ি কাটলে খারাপ লাগতো; আবার খুশিও হতাম একসাথে এতো ঘুড়ি দেখে।‘
কিন্তু এখন আর আগের মতো হয়না। সবকিছু কেমন বদলে যাচ্ছে। তবু আমরা এখনো সাকরাইনে ঘুড়ি নিয়ে ছাদে উঠি, ছাদ সাজাই, আনন্দ করি। বলছিলেন, আঞ্জুমান ফাহী।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী “ব্রিটিশ আমলের এই উৎসবটি এখন বাংলাদেশের সব মানুষ পালন করেন। পুরনো আমলে গান বাজতো মাইকে, আর এখন লাউডস্পীকারে গান বাজানো হয়। আগে আমরা খিচুড়ি করতাম এখন হয়তো কেউ বিরিয়ানি রাঁধে।”
উৎসবের কায়দা আগের মতো আছে বলেই মনে করেন তারা। ছোটবেলার রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ানোর স্মৃতিকে বাস্তব করতেই তারা ছুটে যান পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্যবাসী উৎসবে।