পনের’শ শতকের শুরুতে ভারতবর্ষে আগমনের মাধ্যমে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়। ইউরোপীয়রা যেসব পণ্য ভারত থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেত তারমধ্যে অন্যতম ছিল মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়!
সে প্রায় চারশত বছরের কথা। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তখন রানী প্রথম এলিজাবেথ। এলিজাবেথ ও হাজারি গুড়ের নাম জড়িয়ে একটি জনশ্রুতিও রয়েছে। শত শত বছর ধরে সে জনশ্রুতির চর্চা হয় মানিকগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, হাজারি গুড়ের স্বাদ ও গন্ধে মুগ্ধ হয়েছিলেন রানী এলিজাবেথ। তারপর তিনি নিজেই অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই গুড়ের কথা। ফলে অতিদ্রুতই ইউরোপীয় বণিকদের চাহিদার শীর্ষে চলে যায় হাজারি গুড়।
মন মাতানো গন্ধ আর অতুলনীয় স্বাদের কারণে দেশের মানুষ এক নামেই চেনে মানিকগঞ্জের হাজারি গুড়কে। বংশ পরম্পরায় হাজারি পরিবারের হাত ধরে শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে জেলার ঝিটকা উপজেলায় এখনও টিকে আছে এই গুড়। শুধু দেশেই নয়, এই গুড়ের স্বাদ ও গন্ধ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে ইউরোপের লন্ডন, ইতালি, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। তাই এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হাজারি গুড়কে দেওয়া হয়েছে সরকারি স্বীকৃতি, জেলার ব্রান্ডিং নামকরণও করা হয়েছে “ঝিটকার হাজারি গুড়”কে।
মনে হতে পারে ব্যতিক্রম কোনো উৎসের রস থেকে তৈরি হয় হাজারি গুড়! আসলে তা নয়, সাধারণ খেজুরের রসই এই হাজারি গুড়ের উৎস। কিন্তু গাছির রস নামানো থেকে শুরু করে গুড় তৈরির মধ্যে রয়েছে আদি ও গোপন প্রক্রিয়া। কালান্তরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও হাজারি গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানান মানিকগঞ্জের হাজারির কারিগরেরা। মানিকগঞ্জের গুড়ের বাজারে খেজুরের গুড়ের বিশাল পসরা বসলেও হাজারি গুড়ে সেখানে অনন্য। এর দামও প্রচলিত গুড়ের দামের তুলনায় দশগুণ বেশি।
মানিকগঞ্জ এর হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা, বাল্লা, গোপিনাথপুরসহ তার আশপাশের গ্রামগুলোতে তীব্র শীত উপেক্ষা করে কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু হয় সেখানকার গাছিদের কর্মযজ্ঞ।
ঝিটকা বাজার পেরিয়ে দু’কিলোমিটার পেরোতেই দেখা হয় গাছি জয়নুদ্দীনের সঙ্গে। একটা চাঁদর মুড়িয়ে তিনি খেজুর গাছে উঠছেন রসের হাঁড়ি নামাতে। একে একে বিশটি গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামানোর পর মিনিট খানেক বিশ্রামের পর আবারও রসের হাঁড়ি নামানোর শুরু, এভাবে একটানা ৫০টির মতো খেজুর গাছে উঠতে হয়েছে তাকে। পরে সমস্ত রস কয়েকটি পাত্রে জড়ো করে বাড়ি নেন তিনি।
পরের গন্তব্য আরও ৫ কিলোমিটার পাশ্ববর্তী গোপিনাথপুর ইউনিয়নের উত্তর পাড়ায় মোজাফফর হাজারি (৪০) বাড়ি। যিনি নানার বাড়ি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন হাজারি গুড় তৈরি সীলমোহর।
গুড় বানানোর ফাঁকে কথা হয় মোজাফফর হাজারির সঙ্গে। নানা সুখ-দুঃখের আলাপের পাশাপাশি তিনি শোনান এক দরবেশের কাহিনী। মোজাফফর হাজারি নানা মকবুল হোসেনের কাছ থেকে শুনেছিলেন ওই দরবেশের গল্প।
একদা এক দরবেশ ঝিটকা এলাকার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় ওই দরবেশ এক গাছির কাছে খেজুরের রস খাইতে চান। কিন্তু গাছি সবে গাছে হাঁড়ি পেতেছেন। কিভাবে তিনি রস খাওয়াবেন?
কিন্তু দরবেশ গাছিকে বলেন, “দেখ তোমার রসের হাঁড়ি ভরে গেছে”। কৌতূহলী গাছি খেজুর গাছে উঠে দেখেন, সত্যিই রসের হাঁড়ি ভরে গেছে। রস খাওয়ানোর পর দরবেশ গাছিকে জানান, ওই রস জ্বাল দিলে অতি সুস্বাদু গুড় পাওয়া যাবে। গাছি ছিলেন হাজারি বংশের লোক। তাই ওই দরবেশই নাকি গুড়ের নামকরণ করেছিলেন হাজারি গুড়।
প্রতি এক হাঁড়ি রস আলাদা আলাদা জ্বাল দিতে হয়। এরপর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ফুটন্ত রস ছেঁকে ঢেলে দেওয়া হয় একটি খাড়া মাটির পাত্রে, যা জালা নামে পরিচিত। ওই জালার দু’পাশে দু’জন ব্যক্তি বসেন কাঠ কিংবা তালের লাঠি নিয়ে। দুজনে মিলে অসংখ্যবার গুড় নাড়তে থাকেন। এভাবে নাড়তে নাড়তে একসময় তা ধবধবে সাদা বাদামি রং ধারণ করে। তারপরই তৈরি হয় সুস্বাদু হাজারি গুড়।
মোজাফফর হাজারি জানান, দাদা বেলায়েত মোল্লা হাজারির সময় থেকে তাদের বাড়িতে হাজারি গুড় তৈরি হয়। বাবা শুকুর আলী বয়স জনিত কারণে এখন আর এই পেশায় নেই। তবে প্রতিদিন উঠানে বসে গুড় তৈরির তদারকি তিনিই করেন। পরামর্শ দেন, কোনো ধরনের ছলচাতুরি আশ্রয় যেন তারা না নেয়। মোজাফফর জানান, এই গুড় তৈরি পেশায় তিনিসহ ভাই সুকচান মোল্লা ও মান্নান মোল্লা হাজারি নিয়োজিত আছেন।
মোজাফফর হাজারির বাড়িতে এসেছিলেন গাছি আমজাদ হোসেন (৫৫)। তিনি জানালেন, রস ও গুড়ের স্বাদ ঠিক রাখতে খেজুর গাছ ও রসের হাঁড়ি পরিচর্চা করতে হয় সতর্কতার সাথে। প্রথমে রসের হাঁড়িগুলো নিম পাতার গরম পানি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর তীব্র রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। একটানা তিন দিন প্রতিটি খেজুর গাছ থেকে রস নামানো হয়। পরে ৫ দিন বিরতি দিয়ে গাছ শুকিয়ে আবারও তিনদিন রস বের করা হয়।
প্রতিদিন বিকেলে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য উঠার আগে) গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে ছেকে ময়লা পরিষ্কার করে টিনের তৈরি তাফাল (পাত্র) বাইন (চুলা) জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় নাড়া ও শুকনো কাঁশফুল।
মায়ের ১৩ বিঘার জমির বিনিময়ে হাজারি গুড়ের সিল
মোজাফফর মোল্লা জানালেন, তার মা মমতাজ বেগম তার বাবার কাছ থেকে ওয়ারিশের ১৩ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। নানার বাড়িতে মায়ের সেই ১৩ বিঘা সম্পত্তির বিনিময়ে ঐতিহ্যবাহী হাজারি গুড়ের সিল পান তারা।
মোজাফফর হাজারির ভাই মান্নান হাজারি জানান, এই হাজারি গুড়ের সুনাম দেশ থেকে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মুরব্বিদের কাছে শুনেছেন, ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকেও এই গুড় উপহার দেওয়া হয়েছিল। তিনি এই গুড় খেয়ে অভিভূত হন। বর্তমানে এই গুড় লন্ডন ইতালি, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানাদেশে যাচ্ছে।
মোজাফফরের অপর ভাই সুকচান মোল্লা হাজারি জানালেন, বর্তমানে প্রায় একশত গাছি হাজারি গুড় তৈরি করছেন। গুড়ের চাহিদা এতোই বেশি যে কারণে কয়েক মাস আগেই গুড় অর্ডার করা থাকে। নামি-দামি মানুষ গাড়ি নিয়ে আসেন গুড় নিতে। তবে আগের মতো এখন আর গুড় তৈরি করা যায় না। বর্তমান খেজুর গাছের সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রস জ্বাল করার জ্বালানির বড়ই অভাব।