দীর্ঘ দুই বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের পর, বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) গাজাজুড়ে দেখা গেল এক বিরল উৎসবের চিত্র। হাই স্কুল পরীক্ষার ফল (তাওজিহি) ঘোষণার পর হাজার হাজার শিক্ষার্থী আতশবাজি ফুটিয়ে, গান গেয়ে ও নেচে আনন্দ উদযাপন করে—যা যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডে এখন প্রায় দেখাই যায় না।
যুদ্ধকালীন চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও এই ফল অর্জন করেন প্রায় ৫৬ হাজার শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সী দোয়া মুসল্লেম অর্জন করেছেন গাজায় সর্বোচ্চ নম্বর—৯৯.৭ শতাংশ। ফিলিস্তিনি শিক্ষামন্ত্রী তাকে ফোন করে ‘তুমি একজন নায়িকা’ বলে অভিনন্দন জানালেও, দোয়ার এই সাফল্য একদিকে যেমন ছিল মধুর, অন্যদিকে ছিল বেদনার চাদরে মোড়ানো।
বাবা নেই, তাই আনন্দ অসম্পূর্ণ: মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দোয়া জানান, বাবা নেই—তাই আনন্দ অসম্পূর্ণ।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি হামলায় দোয়ার বাবা বাসাম মুসল্লেম গুরুতর আহত হন। চিকিৎসার জন্য ২০২৪ সালের এপ্রিলে তাকে মিশরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে তিনি মেয়ের পাশে থাকতে পারেননি—এমনকি তার এই ঐতিহাসিক ফল ঘোষণার দিনটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফল ঘোষণার পর সমাপনী অনুষ্ঠানের ছবি বাবাকে পাঠিয়েছেন দোয়া। নার্সিং পড়ার স্বপ্ন দেখা দোয়া এখন বিদেশে পড়ালেখা করে বাবার কাছে দ্রুত মিলিত হওয়ার আশা করেন।
ইউনিসেফ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণে গাজার শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার অভিযোগ তুলে ‘স্কলাস্টিসাইড’ (Scholasticide) বলে অভিহিত করেছেন। ইসরায়েল অবশ্য স্কুল-কলেজ ধ্বংসের অভিযোগের সরাসরি জবাব দেয়নি, তবে দাবি করে যে হামাস এসব স্থাপনা সামরিক কাজে ব্যবহার করে।
ফিলিস্তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, যুদ্ধের কারণে এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থী নিহত এবং ২৭ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। পাশাপাশি, ৭৯২ জন শিক্ষক নিহত এবং ৩,২৫১ জন শিক্ষক আহত হয়েছেন। ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজার ৯৭ শতাংশ স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা: ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ছিল এক কঠিন সংগ্রাম। খান ইউনিসের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা শিক্ষার্থী আল-হাসান আলি রাদওয়ান বলেন, ইন্টারনেট নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, খাবার নেই—এই পরিস্থিতিতে অনলাইনে পড়াশোনা করা অসম্ভব ছিল। তিনি যুদ্ধে তার এক আত্মীয় ও পড়ার সঙ্গীকেও হারিয়েছেন।
বর্তমানে, সদ্য উত্তীর্ণ ৫৬ হাজার শিক্ষার্থীর সামনে বড় প্রশ্ন হলো—তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে কোথায়? গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত দুই বছরে ৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। সব মিলিয়ে, ৯২ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় ধরনের পুনর্গঠন ছাড়া পুনরায় চালু করা সম্ভব নয়।
এই পরিস্থিতিতে অনেকেই দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন। শিক্ষার্থী মোহাম্মদ বিলাল আবু ফারাজ আকুতি জানিয়েছেন, এটা কোনো জীবন নয়—ওরা আমাদের স্কুল-কলেজ সব ধ্বংস করে দিয়েছে। সীমান্ত খুলে দিন। আমরা দেশের বাইরে পড়ালেখা করতে চাই।
তবে এক শিক্ষার্থীর বাবা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, গাজার সব ক্ষত থাকা সত্ত্বেও আমরা খুশি হতে চাই। ছাত্রছাত্রীদের যত দ্রুত সম্ভব শ্রেণিকক্ষে ফিরতে হবে।

