রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রেরিত এক সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি শুধু একজন মহান ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, বরং একজন পরম স্নেহময় পিতাও ছিলেন। তাঁর পারিবারিক ও পিতৃত্বের দিকটি প্রতিটি মুসলিম পরিবারের জন্য অনুকরণীয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ—তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত ২১)
এই আয়াতটি আমাদের শেখায় যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ পিতা, যিনি শুধু সন্তানের দৈহিক প্রয়োজন নয়, তাদের নৈতিক, আত্মিক ও মানসিক বিকাশেও গুরুত্ব দিতেন। তিনি সন্তানদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, ধৈর্য ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন, নৈতিক শিক্ষা দিয়েছেন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তাঁর পিতৃত্বের মূল ভিত্তি ছিল ভালোবাসা, নৈতিকতা ও আখিরাতের কল্যাণে উদ্বুদ্ধ করা।
পুত্র ও কন্যাদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাতজন সন্তান ছিলেন—তিন পুত্র (কাসেম, আবদুল্লাহ ও ইবরাহিম) এবং চার কন্যা (জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতেমা)। পুত্ররা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। পুত্র ও কন্যা সবার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল দৃষ্টান্তমূলক।
পুত্র ইবরাহিম (রা.)-এর প্রতি ভালোবাসা : আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ইবরাহিম (রা.) যখন দুধমাতার কাছে থাকতেন, তখন নবীজি (সা.) শুধু তাকে দেখার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেন, তাকে কোলে তুলে নিতেন এবং চুমু খেতেন। (মুসলিম, হাদিস : ২৩১৬)
ইবরাহিম (রা.) শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় নবী (সা.)-এর হূদয়ে গভীর বেদনা সৃষ্টি হয়। তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে একজন সাহাবি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা হলো রহমত।’ এরপর তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই চক্ষু অশ্রু ঝরাচ্ছে এবং হূদয় বিগলিত হচ্ছে। তবে আমরা মুখে কেবল তা-ই বলব, যা আমাদের রব পছন্দ করেন। তোমার বিরহে আমরা বড়ই ব্যথিত হে ইবরাহিম!’ (বুখারি, হাদিস : ১৩০৩)
এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সমর্পণ থাকা সত্ত্বেও একজন পিতার হূদয়ে সন্তানের জন্য কত গভীর ভালোবাসা থাকতে পারে।
কন্যাদের প্রতি মমত্ববোধ : নবীজী (সা.) কন্যাদের প্রতিও সমান ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করতেন।
জয়নব (রা.) বদরের যুদ্ধে তার স্বামী আবুল আস ইবনে রবি বন্দী হলে জয়নব (রা.) তাকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ হিসেবে একটি হার পাঠান, যা তার মা খাদিজা (রা.) তাকে বিবাহের সময় দিয়েছিলেন। হারটি দেখে নবী (সা.)-এর মন এতটাই বিগলিত হয় যে তিনি সাহাবিদের অনুরোধ করেন যেন আবুল আসকে মুক্তি দিয়ে হারটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সাহাবিরা সানন্দে তা করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬৯২)
রুকাইয়া (রা.) : বদরের যুদ্ধের সময় রুকাইয়া (রা.) গুরুতর অসুস্থ হলে নবী (সা.) তাঁর স্বামী উসমান (রা.)-কে যুদ্ধে না গিয়ে স্ত্রীর সেবা করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন যে উসমান (রা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও বদরের মুজাহিদের সমান সাওয়াব পাবেন।
উম্মে কুলসুম (রা.) : তৃতীয় কন্যা উম্মে কুলসুম (রা.)-এর ইন্তেকালের পর নবী কারিম (সা.) তার কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতেন। তাঁর চোখ থেকে তখন অবিরাম অশ্রু ঝরতো। (বুখারি, হাদিস : ১২৮৫)
ফাতেমা (রা.) : নবী (সা.)-এর সবচেয়ে ছোট কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর প্রতিও গভীর ভালোবাসা ছিল। তিনি ফাতেমাকে ‘আমার দেহের অংশ’ বলে সম্বোধন করতেন এবং বলতেন যে ব্যক্তি ফাতেমাকে যে কষ্ট দেয়, সে যেন আমাকেই কষ্ট দেয়। যখন ফাতেমা (রা.) আসতেন, তিনি দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাতেন, তার হাত ধরে চুমু দিতেন এবং নিজের আসনে বসাতেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন আমাদের জন্য একজন আদর্শ পিতার সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরে। তাঁর পিতৃত্ব ছিল ভালোবাসা, ধৈর্য, নৈতিক শিক্ষা, এবং আধ্যাত্মিকতার এক অনুপম সমন্বয়। তিনি শিখিয়েছেন যে একজন সফল পিতা তিনিই, যিনি শুধু সন্তানের জাগতিক প্রয়োজন মেটান না; বরং তাদের হূদয়কে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং আখিরাতের কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেন।
লেখক : প্রভাষক, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ।