spot_img

বিবিএসের প্রতিবেদন; গৃহস্থালিতে নারীর অদৃশ্য শ্রমের মূল্য ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি

অবশ্যই পরুন

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতিদিন নারীরা যে অবদান রাখছেন, তার বড় অংশ এত দিন অদৃশ্যই থেকে গেছে। রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো, শিশু বা প্রবীণের যত্ন নেওয়া কিংবা অসুস্থ পরিবারের সদস্যকে দেখাশোনা—এসব কাজের পারিশ্রমিক নেই, অথচ এই কাজগুলো ছাড়া পরিবার কিংবা সমাজ চালানোই সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন এই শ্রমকে জাতীয় অর্থনীতির হিসাবে ধরা হয়নি। তবে এবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো নারীর এই অদৃশ্য শ্রমের আর্থিক মূল্য প্রকাশ করেছে, যা পুরো অর্থনীতির জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।

বিবিএসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের গৃহস্থালি ও যত্নমূলক কাজের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা বা ৬.৭ ট্রিলিয়ন টাকা। এই অঙ্ক দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৮.৯ শতাংশের সমান। এর মধ্যে নারীর অবদান ৮৫ শতাংশ বা পাঁচ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অবৈতনিক কাজে দৈনিক একজন নারী ৫.৯ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস অডিটরিয়ামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মমতাজ আহমেদ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার এবং ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিংহ। সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিবিএসের উপপরিচালক আসমা আখতার। তিনি জানান, সময় ব্যবহার জরিপ ২০২১ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসাব করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেনের নুবাইরা জেহেন ‘কেয়ার ক্যালকুলেটর’ নামের একটি সরঞ্জাম ব্যবহার করে দেখান, একজন মানুষ প্রতিদিন কতটা সময় অদৃশ্য শ্রমে ব্যয় করে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নারীরা পুরুষদের তুলনায় গড়ে সাত গুণ বেশি সময় দেন অবৈতনিক কাজে। একজন নারী বছরে প্রায় দুই হাজার ১০০ ঘণ্টা সময় দেন রান্না, ঘর সামলানো এবং শিশু ও প্রবীণের যত্নে। অন্যদিকে একজন পুরুষ এই কাজে ব্যয় করেন গড়ে মাত্র তিন শতাধিক ঘণ্টা। এ কারণে মোট অদৃশ্য শ্রমের প্রায় ৮৮ শতাংশই বহন করছেন নারীরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় চার ট্রিলিয়ন টাকা এবং অবৈতনিক যত্নমূলক কাজের মূল্য প্রায় ২.৭ ট্রিলিয়ন টাকা। উভয় ক্ষেত্রেই নারীর অবদান ৮৫ শতাংশের বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই বিশাল অঙ্কের হিসাব শুধু সংখ্যার প্রকাশ নয়, বরং জাতীয় নীতি ও বাজেটে লিঙ্গভিত্তিক সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যত্ন খাতকে জাতীয় বাজেট ও উন্নয়ন কৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া, আন্ত মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে নীতি প্রণয়ন, বেসরকারি খাতে পরিবারবান্ধব কর্মনীতির প্রসার এবং যত্নকেন্দ্রিক চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ মাহিন্থান জোসেফ মারিয়াসিংহাম এক ভিডিও বার্তায় বলেন, নারীর অদৃশ্য শ্রমকে জাতীয় অর্থনীতিতে দৃশ্যমান করার উদ্যোগ বাং লাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রণী অবস্থানে নিয়ে গেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এই খাতে বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় দিকনির্দেশনা দেবে।

আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী তিন-চতুর্থাংশের বেশি অবৈতনিক গৃহস্থালি কাজ এবং দুই-তৃতীয়াংশ যত্নমূলক কাজ নারীরাই করেন। প্রতিদিন নারীরা প্রায় ১২.৫ বিলিয়ন ঘণ্টা অবৈতনিক কাজ করেন, যার বার্ষিক সর্বনিম্ন মূল্য দাঁড়ায় ১০.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এত বড় অবদান থাকা সত্ত্বেও জাতীয় অর্থনীতির পরিমাপে তা ধরা হয় না। বাংলাদেশের নতুন এই উদ্যোগ সেই বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, নারীর শ্রম দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির ছায়ায় ছিল। এই প্রতিবেদন সেই অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করল। তিনি বলেন, ‘যত্ন অর্থনীতির (কেয়ার ইকোনমি) জন্য একটি ভিন্ন মূল্যবোধ ব্যবস্থার প্রয়োজন। নারীর বিনা মজুরির কাজ নিয়ে মানুষের বিদ্যমান মানসিকতা এমনি পরিবর্তন হয়ে যাবে না। এ জন্য গবেষণা ও জরিপের মতো তথ্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। নতুন তথ্য পাওয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এরই মধ্যে অর্থনৈতিক নীতি আলোচনায় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এই গবেষণা ভবিষ্যতে লিঙ্গ-প্রতিক্রিয়াশীল নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নে সহায়তা করবে।’

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউএন উইমেনের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিং বলেন, ‘যত্ন কোনো খরচ নয়, এটি একটি বিনিয়োগ। ঐতিহ্যবাহী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নারীর অবদান অগণিত। কিন্তু গভীরভাবে প্রোথিত লিঙ্গবৈষম্য ও সামাজিক রীতিনীতির প্রতিফলনের কারণে নারীর যত্ন কাজের অবমূল্যায়ন করা হয়। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’

বিবিএসের পরিসংখ্যান ও তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার বলেন, ‘আমরা যেসব পরিসংখ্যান দিয়েছি তাতেও নারীর বেতনবিহীন কাজের পুরোটা প্রতিফলিত হয় না। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, নারীর অদৃশ্য শ্রমকে অর্থনীতিতে যুক্ত করা হলে শুধু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে না, পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি নির্ধারণেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’

বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। প্রথমবারের মতো নারীর অবৈতনিক শ্রমকে অর্থনীতির পরিসংখ্যানে যুক্ত করে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীর অমূল্য অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।

সর্বশেষ সংবাদ

ফ্রান্সে সরকার বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন, শতশত গ্রেপ্তার

নতুন পেনশন সংস্কার আইনের প্রতিবাদে ফ্রান্সে ব্যাপক সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ব্লক এভরিথিং’ নামে শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ