জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে প্রস্তাবিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতার প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ১২টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। তবে বাকি আটটি বিষয়ে এখনও ভেতরে–বাইরে চলছে আলোচনা। সর্বশেষ আলোচনায় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ইস্যুতে বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রেখে আগামী সংসদ নির্বাচনে ৫ শতাংশ আসনে সরাসরি নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে বেশিরভাগ দল। এই হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর সিদ্ধান্তও আলোচনায় গৃহীত হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সনদের খসড়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে।
তবে আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না হলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২২তম দিনের সংলাপে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ আলোচনায় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ ৪৮–৩), রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ, উচ্চকক্ষ গঠন, সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া, এখতিয়ার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এবং সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া।
সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, একটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত খসড়া সনদ প্রস্তুতের লক্ষ্যে প্রত্যেক অনুচ্ছেদ ধরে আলোচনার সুযোগ না থাকলেও সংশোধনী ও সংযোজনীগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৬৬টি প্রস্তাবিত বিষয়ের মধ্যে শতাধিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তা দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। যেসব বিষয়ে এখনো মতভেদ রয়েছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা চলছে এবং বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণে সব রাজনৈতিক দলই প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে। কমিশন যে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছিল, তা নিয়ে পূর্ণ ঐকমত্য না হলেও বিএনপি স্পষ্টভাবে তাদের মতামত ও ব্যাখ্যা দিয়েছে। এখন বিষয়গুলো সংবিধানে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেটিই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবের মধ্যে মতভেদ রয়েছে—যেমন, এনসিপি ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির প্রস্তাব দেয়, আর সিপিবি, বাসদ, জাসদ, জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সরাসরি ভোটে নির্বাচনের পক্ষে। জামায়াতসহ কিছু ইসলামী দল সংখ্যানুপাতিক বণ্টনের প্রস্তাব দেয়। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বিদ্যমান পদ্ধতিতে ১০০ সংরক্ষিত আসনের ধারায় থাকতে চায়।
কমিশন ১৪ জুলাই একটি সংশোধিত প্রস্তাব দেয়—যেখানে বলা হয়, যে দল ২৫টির বেশি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, তাদের ন্যূনতম এক–তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। অধিকাংশ দল ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। পরবর্তীতে কমিশন বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রেখে ৫ শতাংশ আসনে সরাসরি নারী প্রার্থীর মনোনয়নের একটি সংশোধিত প্রস্তাব দেয় এবং সেটি গৃহীত হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন জানান, প্রথম ধাপে ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫টি আসনে নারী প্রার্থীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনে তা ১২ শতাংশ এবং ধাপে ধাপে তা বাড়িয়ে নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। তিনি বলেন, নারীরা সরাসরি নির্বাচনে নির্বাচিত হোক—এটাই দলের অবস্থান। তবে সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের কথা ভাবা হচ্ছে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, কমিশনের প্রস্তাবে ১০০ আসনের মধ্যে ৫০টিতে সরাসরি ভোটের কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে সংসদের নিম্নকক্ষে আনুপাতিক বণ্টনের পক্ষে তারা মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেও শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করেন।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। জামায়াত নেতা ডা. তাহের বলেন, আইনগত ভিত্তি না থাকলে সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং জনগণের কাছেও এর কোনো মূল্য থাকবে না। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এমন প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে কোনো লাভ নেই যা বাস্তবে প্রতিফলিত হবে না। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনও বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আইনি ভিত্তিসহ জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে, এতে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অন্যথায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে এক করে দাবি আদায় করা হবে। তিনি আরো বলেন, অনেকে জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রকে এক মনে করেন, কিন্তু দুটি আলাদা বিষয়। সনদে রাষ্ট্র কাঠামোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত থাকবে, আর ঘোষণাপত্রে থাকবে আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির হাতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত। এই নিয়োগগুলোর মধ্যে রয়েছে : অ্যাটর্নি জেনারেল, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, টেলিকম নিয়ন্ত্রক কমিশন, সেনা–নৌ–বিমান বাহিনী প্রধান, ডিজিএফআই ও এনএসআই মহাপরিচালক নিয়োগ।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, নারী প্রতিনিধিত্ব ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অগ্রগতি হয়েছে। প্রায় সব দল একমত হয়েছে, জাতীয় সংসদে নারী আসনের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১০০-তে উন্নীত করা হবে। সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে এই বিষয়গুলো যুক্ত হবে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরবর্তী নির্বাচনেই ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন নিশ্চিত করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে তা ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি নির্বাচনে ৫ শতাংশ হারে নারী প্রার্থীর হার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তিনি বলেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই চূড়ান্ত খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ও সংশোধনীর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ইতিমধ্যে ১৪টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে নারী প্রতিনিধিত্ব অন্যতম। রাজনৈতিক দলগুলোকে লিখিত সংশোধনী দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং অনেক দল তা জমা দিয়েছে। কমিশন আজ তা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সংশোধনী গ্রহণ করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে নিয়োগ সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং বৃহস্পতিবার কমিশনের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত অবস্থান জানানো হবে। উল্লেখ্য, আলোচনার একটি পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আলোচনার অগ্রগতি ও মতভেদগুলো তাঁকে জানানো হয়েছে।