spot_img

বৈবাহিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার

অবশ্যই পরুন

শান্তিপূর্ণ বৈবাহিক জীবনের মূল চাবিকাঠি হলো, পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকার পালনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। শুধু সামাজিক বা দাম্পত্য জীবনেরই নয়, বরং আখিরাতের অনন্ত কল্যাণও এ সম্পর্কের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারীমে স্পষ্টভাবে ইরশাদ করেন : ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তমভাবে সংসার (জীবনযাপন) করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)

এই মহত্ সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে শুধু নারীর অধিকার নয়, বরং স্বামীর অধিকারও সমান গুরুত্বের সঙ্গে নির্ধারিত হয়েছে। নিম্নে হাদিসের আলোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বামীর অধিকার ও স্ত্রীদের কর্তব্য তুলে ধরা হলো—
১. স্বামীর অধিকার : শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও সম্মান 
স্বামীর প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা জান্নাতের পথ প্রশস্ত করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন : যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীকে সহবাসের জন্য আহ্বান করে, আর স্ত্রী তা প্রত্যাখ্যান করে এবং স্বামী এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাত কাটায়, তাহলে ফেরেশতাগণ সারারাত ওই স্ত্রীর ওপর লানত করতে থাকেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৯৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪৩৬)

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, স্বামীর যৌক্তিক ও শরয়ি চাহিদার প্রতি স্ত্রীর অবহেলা কত বড় অপরাধ হতে পারে। দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের মানসিক ও শারীরিক চাহিদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জান্নাতে যাওয়ার উপায়। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন : যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে, রমযানের রোজা রাখে, নিজের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে—সে জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। (আল জামিউল সাগির, হাদিস : ৭২০)

এ হাদিস এক নারীকে দুনিয়ায় সহজ কয়েকটি কাজের বিনিময়ে জান্নাতের বহু দরজা উন্মুক্ত হওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। মূল কথা হলো: ইবাদত, পবিত্রতা ও স্বামীর সন্তুষ্টি অর্জন—এই তিনটি ভিত্তির ওপরই নারীর জান্নাতের পথ সুগম হয়

২. স্ত্রীর অধিকার : স্বামীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি সমভাবে গুরুত্বারোপকারী এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেমন স্ত্রীকে স্বামীর অনুগত ও সহচর হতে বলা হয়েছে, তেমনি স্বামীকেও স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ, ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই একে অপরের পরিপূরক—তাদের মধ্যে সহনশীলতা, দয়া ও দায়িত্বশীল আচরণ দাম্পত্য জীবনকে জান্নাতের প্রতিচ্ছবিতে রূপ দেয়।

আল্লাহ তাআলা স্বামীদের উদ্দেশে ইরশাদ করেন : ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও উত্তম আচরণের মাধ্যমে সংসার করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)

তিনি আরও বলেন : ‘যদি তাদের অপছন্দ করো, তবু (সাবধান হও), হতে পারে তোমরা কোনো কিছুকে অপছন্দ করছো অথচ আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)

ইসলাম সংসারকে ভালোবাসা, সহনশীলতা ও কল্যাণের চর্চা হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কখনো যদি স্ত্রীর কোনো আচরণ স্বামীকে অপছন্দনীয় মনে হয়, তবু তাকে অবজ্ঞা বা নির্যাতনের পথ না নিয়ে, সহিষ্ণুতার মাধ্যমে তার গুণাবলি মূল্যায়ন করার শিক্ষা দেয় এই আয়াত।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন : ঈমানদারদের মধ্যে সেই ব্যক্তি পরিপূর্ণতম, যার চরিত্র সর্বোত্তম। আর তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণ করে। (জামে আত-তিরমিজি, হাদিস : ১১৬২, সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৬৮২)

স্বামীর উত্তম চরিত্র ও সততা কেবল বাহ্যিক পরিধিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং স্ত্রীর সাথে সদাচরণ ও উদারতাই তার ঈমানের পূর্ণতার এক গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের (স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন ও কর্মচারীদের) সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে, আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার পরিবারের সঙ্গে সবচেয়ে উত্তম ব্যবহারকারী। (জামে আত-তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৯৫; সুনানে দারেমি, হাদিস : ২২৬০)

এ হাদিস প্রমাণ করে, ভালো মানুষ হওয়া শুধু মসজিদ বা জনসম্মুখে নয়—ঘরের ভেতর স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে আচরণই প্রকৃত মহত্বের মানদণ্ড।

একনজরে স্ত্রীর করণীয়
ক. স্বামীকে সম্মানের সঙ্গে দেখা।
খ. তার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা বজায় রাখা।
গ. স্বামীর কল্যাণচিন্তা ও সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করা,

একনজরে স্বামীর করণীয়
ক. স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ, দয়া ও মর্যাদাবোধ রাখা।
খ. তাকে আল্লাহর দানকৃত নিআমত হিসেবে বিবেচনা করা।
গ. তার প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও প্রয়োজন পূরণের আন্তরিক চেষ্টা করা।
ঘ. ভুলভ্রান্তি হলে তা সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করে হিকমতের মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা করা।

মোটকথা, ইসলাম স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের ওপর একে অপরের প্রতি দায়িত্ব আরোপ করেছে—যাতে তারা একটি সুন্দর, পরিপূর্ণ ও পূর্ণ আস্থা ও ভালোবাসায় পূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। স্বামীর কর্তৃত্ব যেন কঠোরতা না হয়, স্ত্রীর আনুগত্য যেন হীনমন্যতা না হয়; বরং দুজনেই যেন পরস্পরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যোগসূত্রে এক অনন্য দাম্পত্যজীবন গড়ে তোলে। দাম্পত্যজীবন এক প্রশান্তির নীড়্ত যেখানে স্ত্রী হয় স্বামীর হূদয়ের স্নিগ্ধ ছায়া, আর স্বামী হয় স্ত্রীর নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের দূর্গ। এই সম্পর্ক যত গভীরতর হবে, ততই জীবন হবে জান্নাতের পথে অগ্রসর। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নিজ নিজ স্বামী-স্ত্রীর হক ও অধিকার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: মুদাররিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
জামিয়া মাদানিয়া শুলকবহর, চট্টগ্রাম।
arfasadibnsahin@gmail.com

সর্বশেষ সংবাদ

নির্বাচন ভণ্ডুলের অপচেষ্টা রুখে দিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

পতিত শক্তি গন্ডগোল লাগিয়ে নির্বাচনের আয়োজনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা করছে। এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে ফ‍্যাসিবাদবিরোধী সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে...

এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ