দারিদ্র্য ও ক্ষুধা মোকাবিলার জন্য বৈশ্বিক চুক্তি, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গাজা অঞ্চলে আরো সহায়তা দান এবং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে যুদ্ধের অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বের ২০টি প্রধান অর্থনীতির দেশের নেতারা।
সোমবার এ বিষয়ে একটি যৌথ ঘোষণা জারি করেন তারা। তবে এই ঘোষণাকে সাধারণ দিক-নির্দেশনা বলা যায়, এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট কৌশল বা বিস্তারিত কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়নি এতে।
যৌথ বিবৃতিতে জোট সদস্যরা সমর্থন করলেও সম্পূর্ণ ঐকমত্য অর্জন করা যায়নি। এতে ভবিষ্যতে বিলিওনিয়ারদের ওপর একটি বৈশ্বিক কর আরোপ এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের বাইরেও সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তিন দিনের এ বৈঠকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সমবেত নেতাদের নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবেন কি না-তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করেন।
প্রাথমিক খসড়ায় কিছু ভাষার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ জানায় আর্জেন্টিনা এবং এটিই একমাত্র দেশ যা সম্পূর্ণ ঘোষণায় সমর্থন করেনি।
স্বাধীন রাজনৈতিক পরামর্শক ও ব্রাজিলের সাবেক মন্ত্রী টমাস ট্রমা বলেন, ‘যদিও এটি সাধারণ, তবে ব্রাজিলের জন্য এটি ইতিবাচক চমক। এমন সময়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এ মুহূর্তে কোনো ঘোষণা দেয়া হবে বলেই আশঙ্কা ছিল। এত সতর্কতা সত্ত্বেও এটা লুলার জন্য ইতিবাচক।’
যুদ্ধের নিন্দা, শান্তির ডাক, কোনো দোষারোপ নয়
ইসরাইলে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার এক বছরের বেশি সময় পরে এ ঘোষণাপত্রে ‘গাজার বিপর্যয়কর মানবিক পরিস্থিতি এবং লেবাননে উত্তেজনা বৃদ্ধির’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানবিক সহায়তা সম্প্রসারণ এবং বেসামরিক নাগরিকদের আরো ভালোভাবে রক্ষা করার জরুরি প্রয়োজনের উপর জোর দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি আমরা সমর্থন দিচ্ছি। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমাদের অঙ্গীকার অবিচল। অর্থাৎ ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র শান্তিতে পাশাপাশি বসবাস করবে।’
এতে ইসরাইলের দুর্ভোগ বা হামাসের হাতে বন্দী থাকা ১০০ জনের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ইসরায়েল জি-২০ এর সদস্য নয়। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরাইলের অভিযানের পর যুদ্ধে গাজায় এ পর্যন্ত ৪৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং লেবাননে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে।
ইসরাইলের দুর্দশার উল্লেখ যে বাদ পড়েছে, তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি ধারাবাহিক সমর্থনের বিপরীতে চলে বলে মনে হয়েছিল।
এটি এমন একটি বিষয় যা বাইডেন সর্বদা প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন, এমনকি যখন তিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর অবহেলার বিষয়েও কথা বলেন। জি-২০ নেতাদের সাথে বৈঠকে ঘোষণা চূড়ান্ত করার আগে বাইডেন বলেন, হামাসই এই যুদ্ধের একমাত্র দায়ী এবং তিনি অন্যান্য নেতাদের কাছে হামাসের ওপর চাপ বাড়ানোর আহ্বান জানান; যেন তারা একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি মেনে নেয়।
ইউক্রেনকে আরো গভীরভাবে রাশিয়ার ভেতরে আঘাত হানতে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিষয়ে বাইডেনের সিদ্ধান্তও এই বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সম্মেলনে বাইডেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সমর্থন করে। আমার মতে, এই টেবিলের চারপাশে বসা সবারই এভাবে সমর্থন করা উচিত।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৈঠকে উপস্থিত হননি। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভকে পাঠিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাকে গ্রেফতার করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করার পর থেকে পুতিন এসব সম্মেলন এড়িয়ে চলছেন।
জি-২০ ঘোষণাপত্রে ইউক্রেনে মানবিক বিপর্যয়ের উল্লেখ করা হয়েছে এবং শান্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে সেখানে রাশিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়নি।
রিও ডি জেনেইরোর স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক পাওলো ভেলাসকো বলেন, ‘ঘোষণাটি দোষীদের প্রতি আঙুল তোলার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ এতে ইসরাইল বা রাশিয়ার সমালোচনামূলক কোনো উল্লেখ নেই। তবে উভয় ক্ষেত্রেই মানবিক সঙ্কটের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।’
পুরো ঘোষণাপত্রটি স্পষ্টতার অভাবে ভুগছে বলেও মন্তব্য করেন ভেলাসকো।
তিনি বলেন, ‘এটি অনেকটাই ব্রাজিলের প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু যদি আমরা এটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব এটি মূলত ইচ্ছাপ্রকাশের একটি ঘোষণা। এটি বিভিন্ন বিষয়ে সদিচ্ছার প্রকাশ, তবে এতে খুব কমই সুনির্দিষ্ট, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ রয়েছে।’
বৈশ্বিক বিলিওনিয়ারদের ওপর কর আরোপের উদ্যোগ
ঘোষণায় বৈশ্বিক বিলিওনিয়ারদের ওপর সম্ভাব্য কর আরোপের কথা বলা হয়েছে, যা লুলা সমর্থন করেন। এই ধরনের কর বিশ্বের প্রায় তিন হাজার ধনী ব্যক্তিকে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ জন লাতিন আমেরিকায় রয়েছেন।
আর্জেন্টিনার বিরোধিতা সত্ত্বেও এই ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তেমনিভাবে একটি ধারা লিঙ্গ সমতার প্রসারেও উৎসর্গ করা হয়েছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রাজিল এবং অন্য দেশের কর্মকর্তারা।
আর্জেন্টিনার আপত্তি সত্ত্বেও জি-২০ ঘোষণায় স্বাক্ষর
আর্জেন্টিনা জি-২০ ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেও জাতিসঙ্ঘের ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার উল্লেখ নিয়ে আপত্তি জানায়। দেশটির ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই এই এজেন্ডাকে ‘সমাজতান্ত্রিক প্রকৃতির একটি অতিরাষ্ট্রীয় প্রোগ্রাম’ বলে অভিহিত করেছেন। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণাত্মক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের আহ্বান এবং ক্ষুধা মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। তিনি এটিকে জাতীয় সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন।
মিলেই প্রায়ই বহুপাক্ষিক আলোচনায় বিশেষ করে তার প্রকাশ্য সমালোচক লুলার নেতৃত্বাধীন বৈঠকে ট্রাম্পের মতো বাধা সৃষ্টিকারীর ভূমিকা পালন করেন।
বৈশ্বিক ক্ষুধা মোকাবিলায় নির্দিষ্ট উদ্যোগ
ঘোষণাপত্রের বড় একটি অংশই ক্ষুধা নির্মূলের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এটি লুলার অগ্রাধিকার।
ব্রাজিল সরকার বলেছে, ‘ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জোট’ চালু করা জি-২০ ঘোষণার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিলের মতে, এরই মধ্যে ৮২টি দেশ এই পরিকল্পনায় সই করেছে। এই উদ্যোগ রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠনগুলোর সমর্থন পেয়েছে।
রোববার রিওর কোপাকাবানা সৈকতে একটি প্রতীকী প্রদর্শনীতে ৭৩৩টি খালি থালা সাজানো হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে ক্ষুধার্ত ৭৩৩ মিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এই প্রদর্শনী।
ব্রাজিলের জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্বের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন দারিদ্র্যবিরোধী অলাভজনক সংস্থা অক্সফামের একজন পরিচালক ভিভিয়ানা সান্তিয়াগো। চরম বৈষম্য, ক্ষুধা ও জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের দাবির প্রতি সাড়া দিতে এবং বিশেষত ধনীদের উপর কর আরোপের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তিনি।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ব্রাজিল আরো ন্যায়সঙ্গত এবং স্থিতিশীল বিশ্বের পথে আলো দেখিয়েছে। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে অন্যদেরও তাদের সাথে যুক্ত হতে চ্যালেঞ্জ আহ্বান জানিয়েছে’
বহু প্রতীক্ষিত জাতিসঙ্ঘ সংস্কার
নেতারা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ‘রূপান্তরমূলক সংস্কার’ নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। ‘২১ শতকের বাস্তবতা ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আরো প্রতিনিধিত্বমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, দক্ষ, কার্যকর, গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধ’ হতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তারা।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমরা এমন নিরাপত্তা পরিষদের সম্প্রসারিত কাঠামোর আহ্বান জানাই, যা আফ্রিকা, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের মতো কম প্রতিনিধিত্বশীল এবং অপ্রতিনিধিত্বশীল অঞ্চল ও গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্ব উন্নত করবে।’
সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ শীর্ষ সম্মেলনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, তারা আফ্রিকার দু’টি দেশের জন্য নতুন স্থায়ী আসনের সমর্থন করছে, তবে ভেটো ক্ষমতা ছাড়া। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো একটি ছোট দ্বীপ উন্নয়নশীল দেশের জন্য অস্থায়ী আসনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
তবে গ্রুপ অব ফোর (ব্রাজিল, জার্মানি, ভারত ও জাপান) একে অপরের স্থায়ী আসনের দাবির পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান, ইতালি, তুরস্ক ও মেক্সিকোসহ এক ডজন দেশের বৃহত্তর ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস গ্রুপ দীর্ঘ মেয়াদের অতিরিক্ত অস্থায়ী আসন চায়।
সূত্র : ইউএনবি