বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৫৯ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এ ঋণের বেশির ভাগ আবার চলে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে।
দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি একটি গোপনীয় প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জুলাই-অক্টোবর মেয়াদে ট্রেজারি বিল এবং বন্ড ইস্যু করে দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে ৫৯ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৩৯ হাজার ১০৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে চলতি অর্থবছরে আংশিকভাবে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিলেও এ সময়ে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ কম ছিল ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।
সরকারি ঋণ-ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রাজস্ব কমে যাওয়ার কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। তিনি আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায়ে প্রভাব ফেলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মেয়াদে রাজস্ব সংগ্রহ ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ বা ৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা কমে গেছে। প্রথম প্রান্তিকে এনবিআর ৭০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের ৭৫ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকার চেয়ে কম। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা।
আশা করছি, এ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়বে। কারণ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে।
ঘাটতি অর্থায়ন পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার পরিবর্তে সরকার প্রধানত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সরকারকে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণসুবিধা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কৌশল ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স সুবিধার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। সেখানে কোনো বিনিয়োগ না করেই সরকার দৈনন্দিন খরচ মেটাতে ১২ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। এ ছাড়া একই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওভার ড্রাফট সুবিধার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার সুবিধা পায় সরকার।
কর্মকর্তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন সংশোধন এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প স্থগিত করার কারণে অদূর ভবিষ্যতে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের সতর্ক ব্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, সরকার চলতি অর্থবছরের ২০২৪-২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এডিপি বরাদ্দের ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ ব্যয় করেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা আগের বছরে ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছর সরকার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ ছিল ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা।
এ ব্যবস্থার আওতায় সরকার দীর্ঘমেয়াদি বন্ড ইস্যু করে ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ঋণ নেবে এবং বাকি ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা নেবে ট্রেজারি বিলের (টি-বিল) মাধ্যমে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারি ঋণের সমন্বয় করতে বর্তমানে চারটি টি-বিল নিলামের মাধ্যমে লেনদেন করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ১৪ দিন, ৯১ দিন, ১৮২ দিন এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি।
এ ছাড়া দুই, পাঁচ, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি পাঁচটি সরকারি বন্ডে লেনদেন করা হয়। বেসরকারি খাতের একটি শীর্ষ বাণিজ্যিক ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহীর মতে, ভালো মুনাফা এবং নিরাপদ হওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের অতিরিক্ত তহবিল সরকারি বিল বন্ডে বিনিয়োগ করতে পছন্দ করে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেসরকারি খাত থেকে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ঝুঁকিমুক্ত সরকারি বিল বন্ডে বিনিয়োগকে উৎসাহি করছে।