কোভিড-১৯ সংক্রমণ তীব্রতা লাভ করায় বিশ্বব্যাপী বাড়ছে গুরুতর আক্রান্তদের সংখ্যা, যাদের প্রাণরক্ষায় অক্সিজেন সরবরাহ একেবারেই আবশ্যক। কিন্তু, এক ডজনের বেশি দেশে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে অক্সিজেনের সঙ্কট। এতে করে দেশগুলোর সম্পূর্ণ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
লন্ডন ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অলাভজনক সংস্থা- ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা- এভরি ব্রেথ কাউন্টস কোয়ালিশন, দ্য এনজিও পাথ এবং ক্লিনটন হেলথ অ্যাক্সেস ইনিশিয়েটিভ- এর দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে চিহ্নিত করে। একইসঙ্গে, সংস্থাটি বৈশ্বিক টিকাদানের হারও অধ্যয়ন করেছে।
মার্চের পর থেকে অক্সিজেন চাহিদা ন্যূনতম ২০ শতাংশ বাড়ায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, আর্জেন্টিনা, ইরান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ১৯টি দেশ। অথচ, এসব দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরও কম নাগরিককে টিকাকরণের আওতায় আনা গেছে।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ অক্সিজেন উৎপাদন ও বিতরণের সীমিত অবকাঠামো থাকা লাওসের মতো এশীয় দেশের মহামারি পরিস্থিতি। আফ্রিকায় নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মালাওয়ি এবং জিম্বাবুয়েকে নিয়েও একইরকম আশঙ্কা করা হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, এসব স্থানে হঠাৎ করে অক্সিজেনের চাহিদা সামান্য পরিমাণ বাড়লেও তা বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে।
এভরি ব্রেথ কোয়ালিশনের সমন্বয়ক লেইথ গ্রিনস্লেড জানান, মহামারির আগেও এসব দেশ অক্সিজেন সঙ্কট লক্ষ্য করেছিল। তারমধ্যে বাড়তি চাহিদা যোগ হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার দিকে এগোচ্ছে।
“গেল বছর এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্রাজিল ও পেরুতে স্বল্পতার যে ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা গিয়েছিল, সেখান থেকে সকলের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু, বিশ্ব সচেতন হয়নি। লাতিন আমেরিকায় যা হয়েছে, তা দেখেই ভারতে সঙ্কট দেখা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের আগেই বুঝে নেওয়া দরকার ছিল। এখন এশিয়ার অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, আফ্রিকার কিছু বড় শহরেও একই বিপর্যয় আঘাত হানবে,” গ্রিনস্লেড বলেন।
মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী অক্সিজেনের চাহিদা পরিমাপ করাসহ, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনিয়গকারীদের সঙ্গে কাজ করা সংস্থা- কোভিড-১৯ অক্সিজেন ইমার্জেন্সি টাস্কফোর্সের প্রধান রবার্ট ম্যাটিরু বলেন, “দুর্বল অবকাঠামোর দেশে আমরা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মতো বিপর্যয় লক্ষ্য করতে পারি।”
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধের লড়াই চলাকালেই ভারতে অক্সিজেনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘাটতি দৃশ্যমান। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী মে নাগাদ দেশটির দৈনিক সাড়ে ১৫ মিলিয়ন ঘন মিটার অক্সিজেন দরকার হবে শুধু কোভিড রোগীদের জন্যেই। মার্চে যা চাহিদা ছিল এটি তার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি বলে ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের বিশ্লেষণে জানানো হয়।
বাড়তি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাওয়া ভারত সরকার সকল প্রকার তরল সিলিন্ডারজাত অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করেছে।
কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা এখন ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের অবস্থা নিয়েই বেশি চিন্তিত, কারণ এসব দেশ ভারতে উৎপাদিত অক্সিজেন ও সরঞ্জামের ওপর কিছু মাত্রায় হলেও নির্ভরশীল।
“এই দেশগুলোয় যদি হঠাৎ করে ভারতের মতো নাটকীয় গতিতে সংক্রমণ সর্বোচ্চ মাত্রা লাভ করে, তাহলে কী হবে একবার কল্পনা করে দেখুন। নিজ চাহিদা পূরণে ভারত তার সব অক্সিজেন ব্যবহার করায় প্রতিবেশী দেশের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হতে বাধ্য,” বলছিলেন ক্লিনটন হেলথ অ্যাক্সেস ইনিশিয়েটিভের জরুরি ওষুধ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যাকারি কাৎজ।
গবেষকরা তাদের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে জানান, এই মুহূর্তে নেপালে মার্চের তুলনায় অক্সিজেন চাহিদা ১০০ গুণ বেড়েছে।
মার্চের পর থেকে শ্রীলঙ্কার চাহিদা বেড়েছে ৭ গুণ। অন্যদিকে, সংক্রমণের তৃতীয় তরঙ্গের মধ্যে থাকা পাকিস্তানে গেল বছরের মার্চের সর্বোচ্চ সময়ে যতো রোগী হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্টে ছিলেন, তার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি রয়েছেন বর্তমানে। পাকিস্তানের এক মন্ত্রী এই তথ্য জানান। গত এপ্রিলেই এই মন্ত্রী অক্সিজেন সরবরাহের ওপর মারাত্মক রকম চাপ সৃষ্টির কথা জানিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
করাচির এক চিকিৎসক ডা. ফয়েজা জেহান বলেন, “ভারতের মতো পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সকলেই ভয় পাচ্ছি। ভোজবাজির মতো সংক্রমণের তীব্রতা কমবে এমন আশা করছি আমরা, কিন্তু, চলমান লকডাউনও নতুন কেস সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।”
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান