গ্যাসের অবৈধ সংযোগ, গ্যাস লিকেজ, রাস্তা খনন, সুয়ারেজ লাইন সংস্কারে সময় গ্যাস বিস্ফোরণে সারা দেশে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। গ্যাস বিস্ফোরণের ফলে গত তিন বছরে ৫ হাজার ৬৫০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহতের ঘটনা চলতি বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ বছর শতাধিক লোক গ্যাস বিস্ফোরণে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০০ জন। এর মধ্যে দুই বছর আগে রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান ৮১ জন। অনেকের অভিযোগ তিতাস গ্যাস কোম্পানির দায়িত্বে অবহেলার কারণে দিন দিন দুর্ঘটনা বেড়ে চলছে।
গত ১২ বছরে সারা দেশে গ্যাস বিস্ফোরণ সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় কমপক্ষে সাড়ে ৯০০ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন প্রায় ৭ হাজার। ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস, বিস্ফোরক পরিদফতর ও বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্য থেকে এ তথ্য জানা গেছে। গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের দায়িত্ব অবহেলার কারণে আশঙ্কাজনক হারে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের উদ্দেশে করণীয় বিষয়ে সতর্কতামূলক নোটিশ জারি করেছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। কিন্তু তিতাস তাদের গ্যাস লাইনগুলো পরিষ্কার ও সংস্কার করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, গ্যাস লিকেজের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। রাস্তা খনন, সুয়ারেজ লাইন সংস্কারে সময় গ্যাস কর্তৃপক্ষ এগুলো দেখে না। অথচ লাইন সংস্কারের বরাদ্দ রয়েছে। সে টাকাগুলো কে খায়। তা কেউ জানে না। গ্যাস কোম্পানির দায়িত্বে অবহেলার কারণে দিন দিন দুর্ঘটনা বাড়ছে। এ দুঘর্টনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
গ্যাস বিস্ফোরণে নিহতের ঘটনা চলতি বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সারা দেশে জানুয়ারি থেকে ডিসিম্বর পর্যন্ত গ্যাস বিস্ফোরণ সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন শতাধিক। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজন, এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণে দু’জন, অক্টোবরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বেলুন বিক্রির সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশু ও মানিকগঞ্জে একই পরিবারের তিনজন নিহত হন। পরে চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় নিহত হয়েছেন সাতজন। বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, গত ১২ বছরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ সংক্রান্ত ৯ শতাধিক দুর্ঘটনায় দেড় হাজার লোক হতাহত হয়েছেন। প্রতিবছর সারা দেশে গড়ে ৫-৬টি বড় ধরনের গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। বিস্ফোরণে বছরে গড়ে নিহত হন ৫০-৬০ জন। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে গ্যাস দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিকান্ড ঘটেছে ১৫৬টি। ২০১৬ সালে গ্যাসজনিত দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৬-এ। ২০১৭ সালে প্রায় ১৫০টি। তবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে গ্যাসের চুলা থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৩৮টি, আর গ্যাস লিকেজের জন্য ঘটেছে ৫ হাজার ৬৫০টি দুর্ঘটনা। ২০১৮ সালে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অবশ্য তিতাসের পরিসংখ্যানকে সমর্থন করে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গত বছর চুলার আগুন থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৪৪৯টি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যাওয়াদের তথ্য ফায়ার সার্ভিসের কাছে না থাকায় হতাহতদের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারেনি তারা।
গত ২৫ এপ্রিল তিতাসের জারি করা নোটিশে বলা হয়, বাসাবাড়িতে গ্যাস দুর্ঘটনা রোধে রান্নাঘরে সার্বক্ষণিক বায়ু প্রবাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। রান্নাঘরের দরজা জানালা খোলার ১০-১৫ মিনিট পর চুলা জ্বালান এবং বৈদ্যুতিক সুইচ অন করুন। গ্যাসের গন্ধ পেলে চুলা জ্বালাবেন না। বৈদ্যুতিক সুইচ অন করবেন না। রান্নাশেষে চুলা বন্ধ রাখুন এবং নিয়মিত গ্যাস লাইন ও চুলার লিকেজ পরীক্ষা করুন। এছাড়া প্রয়োজনে কল সেন্টারের ১৬৪১৬ নম্বরে কল করত বলেছে তিতাস।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্র জানায়, সারা দেশ থেকে গড়ে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ শত জন আগুনে পোড়া রোগী ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন এক-পঞ্চমাংশ রোগী। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৪০ শতাংশই গ্যাসের আগুনে দগ্ধ। দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন অনেক দগ্ধ রোগী।
রাজধানীর উত্তরায় ওই কারণে একই পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ হন, যেখানে এরই মধ্যে মারা গেছে তিনজন। সংশ্লিষ্টরা এজন্য ব্যক্তির অসচেতনতাকে দায়ী করলেও গ্যাসের লাইনে ঘন ঘন ছিদ্র কেন হচ্ছে বা কার অবহেলায় হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার ওপরও জোর দিচ্ছেন তারা। গ্যাস লাইনে ছিদ্র থাকায় আগুন লেগে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ওই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের অবস্থাও কম বেশি একই রকম। উত্তরার ওই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সচেতন না হলে প্রতিটি বাড়ি হতে পারে এক একটি মৃত্যুক‚প।
চলতি বছরের গত ২৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ফতুল্লার তল্লা জামাই বাজার এলাকার তিন তলা ভবনের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে রান্না ঘরের গ্যাসের লিকেজ থেকে গ্যাস জমাট বেঁধে বিস্ফোরণ হয়। এই দুর্ঘটনায় ১১ জন দগ্ধ হয়েছেন। এর আগে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা যান ২৭ জন। এদিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এই ঘটনায় তিতাস গ্যাসের প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (অপারেশন-অতিরিক্ত দায়িত্ব) শফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, তিতাস গ্যাস নরসিংদী আঞ্চলিক অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী অজিত চন্দ্র দেব ও ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী বোরহান উদ্দিন। এর আগে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহিমা বেগমকে আহকয়ক করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সেরে মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন, এনডিসি, এএফডবিøউসি, পিএসসি, এমফিল ফোনে ইনকিলাবকে বলেন, এসব দুর্ঘটনা সা¤প্রতিক সময়ে বেশি হচ্ছে। নতুন গ্যাস সংযোগ নিতে যারা যায় এবং যারা সিলিন্ডার গ্যাস সংযোগ নিচ্ছে সেক্ষেত্রে হচ্ছে। গ্যাস লিক (ছিদ্র) হলে বোঝা যায়, শব্দ হবে, গন্ধ আছে। আলামত বুঝতে পারলে কোনো অবস্থাতেই আগুন জ্বালানো, সুইচ বন্ধ, চালু করা, মোবাইল ব্যবহার করা উচিত না।
এদিকে তিতাস গ্যাসের উপমহাব্যবস্থাপক ফয়জার রহমান বলেন, গ্যাস বন্ধের দুটি উপায় আছে। হাউস লাইনের সাইডেও আছে। প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাইজার বন্ধ করে সকালে চালু করা হলে আমি মনে করি শতভাগ দুর্ঘটনামুক্ত থাকা যাবে। চুলার সঙ্গে হাউস লাইনে যে সংযোগটি থাকে সেখানে অনেক সমস্যা আমরা দেখতে পাই। সেটা অনেক সময় ত্রæটিপূর্ণ থাকে। সেখান থেকেই লিকেজটা বেশিরভাগ সময়ে দেখা দেয়। অবৈধ গ্যাসের সংযোগ, রাস্তা খননকালে আমাদের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে ঘরে প্রবেশ করে দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।