করোনাভাইরাসে পুরো ভারত কাঁপছে এখন। লাশ পোড়াবার পর্যন্ত জায়গা নেই। ‘একটু অক্সিজেনে’র জন্য হাঁসফাস করছে পুরোটা দেশ। প্রতিদিনই তিন লাখের বেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুবরণ করছে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ। হাসপাতালগুলো মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতে দিব্যি আইপিএল চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই। মুম্বাই, চেন্নাই এবং আহমেদাবাদে চলছে আইপিএলের খেলা। যদিও দর্শক উপস্থিতি নেই। ক্রিকেটারদের রাখা হয়েছে কঠোর বায়ো সিকিউর ব্যবস্থার মধ্যে।
কিন্তু এর মধ্যে যখন পুরো দেশে করোনার কারণে অক্সিজেনের হাহাকার, একপ্রকার মৃত্যুপুরিতে পরিণত, তখন কোটিপতি লিগ হিসেবে পরিচিত আইপিএল কিভাবে চলছে?
এ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে অনেক আগেই। তারওপর, করোনার ভয়াল থাবার কারণে বিদেশি ক্রিকেটাররাও আতঙ্কিত। অনেকেই এরই মধ্যে আইপিএল ছেড়ে গেছেন। অনেকেই ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সবাই প্রত্যাশা করছিল আইপিএল স্থগিত ঘোষণা করা হবে। কিন্তু না! ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আইপিএল চলবে। ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার জন্য বায়ো সিকিউর ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা হবে।
বিসিসিআই’র পক্ষ থেকে আইপিএল চালানোর সাফাই গেয়ে বলা হয়েছে, বর্তমান সময়ে ক্রিকেটাররা আইপিএল শুধু জয়ের জন্য খেলছে না। তারা খেলছে, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছুর জন্য। সেটা হলো ‘মানবতা’।
বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে খেলা বিদেশি ক্রিকেটারদের অধিকাংশই দেশে ফিরতে মরিয়া। তারা চায় যেভাবেই হোক দেশে ফিরে যেতে। কিন্তু ভারত থেকে প্রায় প্রতিটি দেশই ফ্লাইট নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রিকেটাররা কিভাবে দেশে ফিরবে সে চিন্তায় অস্থির।
আবার বিদেশি ক্রিকেটাররা চলে গেলে ফ্রাঞ্চাইজি মালিকরা চিন্তায়, কিভাবে আইপিএল শেষ করবে তারা? তাদের লগ্নি করা টাকা কিভাবে ফেরত আসবে- এ নিয়ে।
এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে বিসিসিআইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান নির্বাহী অফিসার হেমাঙ আমিন মঙ্গলবার প্রতিটি ফ্রাঞ্চাইজির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন এই কথা বলে যে, প্রতিটি দলকে বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে তাদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যাপারে। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তায় বায়ো সিকিউর বাবল আরও শক্তিশালী করারও ঘোষণা দিয়েছে তারা।
ইএসপিএন ক্রিকইনফো হেমাঙ আমিনের সেই চিঠির কপি হাতে পেয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘আমি আপনাদেরকে এমন এক সময়ে লিখছি, যখন ভারত স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবিকতার নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আইপিএলের দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এ কারণে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের নাম প্রত্যাহারের কারণে কিছু উদ্বেগ এবেং শঙ্কা তৈরির বিষয়ে।
যে সব ক্রিকেটার নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেছেন, আমরা তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। তাদের জন্য সব সময় আমাদের সমর্থন থাকবে। একই সময়ে সবাইকে নিশ্চিত করতে চাই যে, আমরা বায়ো-বাবলের মধ্যে সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
নিরাপত্তার জন্য ফ্রাঞ্চাইজিগুলো এবং খেলোয়াড়দের ভ্রমণ কমিয়ে আনার জন্য এবারের আইপিএল ক্যারাভান মডেলে মাত্র দুটি ভেন্যুতে আয়োজন করা হচ্ছে। প্রথম পর্ব আয়োজন করা হয়েছে মুম্বাই এবং চেন্নাইতে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে সোমবার থেকে।
এই পর্বের ম্যাচ আয়োজন হবে আহমেদাবাদ এবং দিল্লীতে। এরপর ম্যাচগুলো কিছু আয়োজন হবে ব্যাঙ্গালুরু এবং কলকাতায়ও। সর্বশেষ প্লে-অফের ম্যাচগুলো আয়োজনের জন্য আইপিএল ফিরে আসবে আহমেদাবাদে।
হেমাঙ আমিন জানিয়েছেন, বায়ো-বাবল শক্তিশালী করার জন্য বিসিসিআই আরো কঠোর হবে। তিনি বলেন, ‘দারুণ উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা তৈরি হওয়ার কারণে আমরা বায়ো-সিকিউর পদ্ধতিকে আরো শক্তিশালী করে নিচ্ছি। যাতে করে এই টুর্নামেন্টের সঙ্গে জড়িত সবাই নিরাপদ থাকতে পারে। যার অংশ হিসেবে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার করোনা টেস্টের সময়সীমা আরো কমিয়ে এনেছি। আগে প্রতি ৫দিন পরপর টেস্ট করা হতো। এখন টেস্ট করা হবে প্রতি দুইদিন পরপর।’
শুধু তাই নয়, ফ্রাঞ্জাইজিদের পছন্দ অনুসারে আগে বাইরে থেকে খাবার আনা হতো। এবার বিসিসিআই সেই সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। নিজেরাই খাবার তৈরি করবে, যাতে ভাইরাস প্রবেশের কোনো পথই খুঁজে না পায়। এসব কারণে বিসিসিআই বলছে, তাদের বায়ো-বাবল পরিবেশই হচ্ছে এখন ভারতের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।
লাখ লাখ আক্রান্ত, হাজার হাজার মৃত্যু প্রতিদিন। তা সত্ত্বেও আইপিএল চলার কারণে তুমুল সমলোচনার শিকার বিসিসিআই। তবুও নিজেদের সিদ্ধান্তকে ‘সঠিক’ তুলে ধরে এর পক্ষে যুক্তিও খোঁজার চেষ্টা করেছে বিসিসিআই। হেমাঙ আমিন জানান, করোনা মহামারির মধ্যে আইপিএল চালানো নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। কারণ, তারা এই দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ প্রাণে নতুন করে ‘আশা’র সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে।
আইপিএলে খেলা প্রতিটি দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যখন আপনি খেলতে যান, যেটাকে আমরা সবাই ভালোবাসি, তখন অবশ্যই আপনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা করছেন। যেমন অনেকেই বলে থাকেন যে, যদি আমি একটি জেলার মানুষকে বর্তমান সময়ের সব সমস্যা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি দিতে পারতাম! তাহলে সেটা হতো খুব বড় একটি কাজ।
যখন আপনি মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যান, তখন অবশ্যই লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে আশা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। এক মিনিটের জন্য হলেও তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারছেন- এটাই অনেক বড় একটি কাজ। আইপিএল হলো পেশাদারিত্বের বড় জায়গা। এখানে সবাই জিততে চায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আপনারা যারা আইপিএল খেলছেন, তারা এর চেয়েও বেশি কিছুর জন্য খেলছেন। সেটা হচ্ছে মানবতা…।’