মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাপ্রধান এশিয়ায় চীনের স্বৈরতান্ত্রিক মডেলের বিরোধিতা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একটি পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন। বুধবার (২১ এপ্রিল) মার্কিন মিডিয়া ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে সেই কথাই তুলে ধরা হয়েছে।
এই বছরই বাধ্যতামূলক অবসরে যাবেন জেনারেল মিন অং হ্লাং। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। যদিও উলটো দিকে তাকে সম্মান জানিয়েছে এশিয়ার পরাশক্তি চীন। গত মাসে এক ৬৪ বছরের জেনারেলের সঙ্গে এক বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই উভয় দেশকে ‘ভাই’ বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে বার্মিজ সেনাবাহিনীর ‘জাতীয় পুনরুজ্জীবনের’ প্রশংসা করেছেন।
‘ড্রাগন’স শ্যাডো : সাউথইস্ট এশিয়া ইন দ্য চাইনিজ সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক সেবাস্টিয়ান স্ট্রাঞ্জিও বলেন, নিশ্চিতভাবে অভ্যুত্থানের মূল্য দিতে হবে। কিন্তু সেনাবাহিনী মনে করছে তা শোধ করতে পারবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখিয়ে দিয়েছে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি, পশ্চিমে গণতান্ত্রিক বিপথগামীতা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অর্থে এজেন্ডা প্রণয়নের নৈতিক কর্তৃত্ব আর নেই।
চীনের উত্থান মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো এশিয়ায় বেইজিংয়ের একদলীয় শাসনের বিপরীতে মুক্ত ও স্বাধীন গণতন্ত্রের পক্ষে ফেরি করা। তবু গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালার মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে প্রভাব হারিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে। যার নির্বাচনে হারের ফলে মার্কিন কংগ্রেস ভবনে ভয়াবহ হামলা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নিপীড়ন সমর্থন করে উৎখাত হওয়া মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির গণতন্ত্রের প্রতীক বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবু এখন মার্কিন কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ মিত্ররা রয়েছে। দলের অপর নেতাদের সঙ্গে বন্দি হওয়া সু চি দেশটির ৫ কোটি ৫০ লাখ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ‘সামরিক স্বৈরশাসনের’ বিরোধিতা করার জন্য।
এখন ব্যাপক জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে মিয়ানমারের জেনারেলদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে উভয় সংকটে পড়েছেন জো বাইডেন। দেশটি নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় ছিল। হোয়াইট হাউজ এরই মধ্যে হুমকি দিয়েছে আগের অবস্থায় ফিরে না গেলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
এছাড়া পদক্ষেপ নিতে আরও চাপে পড়বে মার্কিন প্রশাসন। সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির সম্ভাব্য চেয়ারম্যান ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর বব মেন্ডেজ সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন।
সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল নীরব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন মিয়ানমারকে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী হিসেবে উল্লেখ করে সব পক্ষকে যথাযথভাবে পার্থক্য ঘুচানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
গত বছরের শেষ পর্যন্ত চীন ছিল মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যও বেইজিংয়ের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় তা দশগুণ বেশি। এরপরও চীন সু চির সমর্থকদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এড়ানোর সতর্ক চেষ্টা করবে। গত মাসে সর্বশেষ সফরে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং সু চির সঙ্গে বৈঠক করেন এবং আলোচনা করেন কীভাবে ভারত মহাসাগরে বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্পে সহযোগিতা করা যায়।
স্টিমসন সেন্টারের চায়না প্রোগ্রামের পরিচালক ইয়ুন সুন বলেন, চীনাদের জন্য বার্মার (মিয়ানমার) রাজনীতি ভঙ্গুর ও বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় ভরা। চীন আগেও ভুগেছে।
অপর এশীয় দেশগুলোও নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে। আর যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মিয়ানমারকে নিন্দা জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে অবস্থান নিয়েছে। সামরিক শাসন থাকাকালেও বেশিরভাগ এশীয় দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সম্প্রতি জাপান ও কয়েকটি দেশ পণ্য উৎপাদনে থাইল্যান্ডের বিকল্প হিসেবে নেপিদোতে বিনিয়োগ করছে।
প্রায় এক দশক আগে ক্ষমতা ছাড়লেও দেশ পরিচালনা কর্তৃত্ব ধরে রাখে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। সোমবার (১৯ এপ্রিল) সেনাবাহিনী বলেছে, ক্ষমতা দখল সংবিধান সম্মত। যাতে বলা হয়েছে, জরুরি প্রয়োজনে জেনারেলরা ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারবে।