কোচ জিনেদিন জিদান যতোই বলুন ইতিহাস নিয়ে ভাবছে না তার দল, ম্যাচে ঠিকই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। প্রায় তিন বছর আগে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল রিয়াল। ব্রাজিলিয়ান ভিনিসিয়াস জুনিয়র ও স্প্যানিশ মার্কো অ্যাসেনসিওর গোলে মঙ্গলবার রাতের ম্যাচটাও দেখল সে একই স্কোরলাইন। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে এমন জয়ে সেমিফাইনালে এক পা দিয়েই দিলো জিদানের শিষ্যরা।
স্কোরলাইন ছাড়াও ২০১৭-১৮ মৌসুমের সে ফাইনালের সঙ্গে আরও মিল আছে দুই দলের সর্বশেষ সাক্ষাতের। সে ম্যাচের তিনটি গোলের দুটোই হয়েছিল নিজেদের ভুলে, এবারও দুটো গোলের দায় লিভারপুলের নিজেদেরই। তবে যেখানে মিল নেই সেই ম্যাচের সঙ্গে এবারের সেটা হলো, সেবার ফিরতি লেগে পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল না লিভারপুলের সামনে, যা থাকছে এবার। ফলে টিমটিমে হলেও অল রেডদের আশাটা টিকে আছে এখনো।
অথচ দুই অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার সার্জিও রামোস ও রাফায়েল ভারানকে ছাড়া খেলতে নামা রিয়াল মাদ্রিদের জন্য ম্যাচটা কঠিনই হওয়ার কথা ছিল। যে কারণে শেষ কিছুদিনে দারুণ কাজে আসা ৩ জনের রক্ষণভাগের কৌশল থেকেও সরে আসতে হয়েছিল কোচ জিনেদিন জিদানকে। নিজেদের মাঠ আলফ্রেডো ডি স্টেফানো স্টেডিয়ামে রিয়াল কোচ এদিন ফিরে গিয়েছিলেন ৪-৩-৩ ছকে। রামোস ভারানের জায়গা নিয়েছিলেন এডার মিলিতাও ও নাচো ফের্নান্দেজ। দুই ফুলব্যাক ছিলেন লুকাস ভাসকেজ ও ফেরলান্দ মন্ডি। তাদের সামনে মাঝমাঠে ছিলেন টনি ক্রুস, লুকা মদ্রিচ ও ইস্কো। আর আক্রমণে কারিম বেনজেমার সঙ্গে ছিলেন ভিনিসিয়াস ও অ্যাসেনসিও।
রক্ষণ ভঙ্গুর ছিল লিভারপুলেরও। ফলে কার্যত লড়াইটা হয়ে পড়েছিল দুই দলের আক্রমণভাগের। সে পরীক্ষায় অবশ্য মোহামেদ সালাহরা হয়েছেন ব্যর্থ, প্রথমার্ধে বড় কোনো পরীক্ষাতেই ফেলতে পারেননি মাদ্রিদকে। উল্টো লিভারপুল রক্ষণে ত্রাস ছড়িয়েছেন বেনজেমারা। প্রথম ১৫ মিনিটে গড়েছেন দুটো সুযোগ। শুরুতে বেনজেমার হেডারটা ছিল গোলরক্ষক বরাবর আর ভিনিসিয়াসের শট হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট। নাহয় জিদানের দল এগিয়ে যেতে পারত শুরুর ১৫ মিনিটেই।
সে অপেক্ষা খুব বেশি বাড়েনি দলটির। ২৭ মিনিটে দারুণ এক প্রতি আক্রমণে গোল পায় রিয়াল। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে প্রতিপক্ষ বক্সের কাছে এসে ভিনিসিয়াসের উদ্দেশে লং বল বাড়ান ক্রুস, দুই লিভারপুল ডিফেন্ডারের প্রহরা ফাঁকি দিয়ে বলটা রিসিভ করেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। দারুণ এক ফিনিশিংয়ে রিয়ালকে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে দেন তিনি। ২০ বছর ২৬৮ দিন বয়সে এ গোল করে রিয়ালের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতাও বনে যান ভিনিসিয়াস। তার সামনে ছিলেন কিংবদন্তি রাউল গঞ্জালেস, তার নকআউট গোলটা এসেছিল ১৮ বছর ২৫৩ দিন বয়সে।
লিভারপুল শুরু থেকেই ছিল বিবর্ণ, প্রথম গোলটা হজম করে হয়ে পড়ে দিশেহারাও। নাহয় ৩৬ মিনিটে টনি ক্রুসের লং বলটা বিপদমুক্ত করতে গিয়ে কেন ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আর্নল্ড বাড়িয়ে দেবেন নিজেদের বক্সেই? সুযোগটা কাজে লাগাতে ভুল করেননি মার্কো অ্যাসেনসিও।
বিরতির আগে আরও একবার পা হড়কেছিল লিভারপুল রক্ষণ। ওজান কাবাকের ভুলটা ধরে সেই অ্যাসেনসিওরই করা শটটা গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকারের কল্যাণে বিপদমুক্ত হয় বলে রক্ষা মেলে সফরকারীদের।
প্রথমার্ধে লিভারপুল গোলমুখে ৯টি শট নিয়েছে রিয়াল, লক্ষ্যে ছিল যার চারটি, সেখানে অল রেডরা নিতে পারেনি একটিও। তবে পরিস্থিতি বদলায় বিরতির পর। নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ৫১ মিনিটে ব্যবধান কমায় লিভারপুল। ডিয়েগো জোটার শট মদ্রিচের পায়ে লেগে দিক বদলে যায় সালাহর কাছে। সালাহর দুর্বল শটটাও গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়াকে ফাঁকি দিয়ে জড়ায় জালে, সফরকারীরা পেয়ে যায় মূল্যবান অ্যাওয়ে গোলের দেখা।
প্রথম গোলে নিজের কারিশমা দেখিয়েছিলেন ভিনিসিয়াস, আর দ্বিতীয় গোলে ছিল লিভারপুল রক্ষণের ভুল। দুয়ের যুগলবন্দিই যেন হলো শেষ গোলে। মদ্রিচের পাস প্রতিপক্ষ বিপদসীমায় পেয়ে প্রথম ছোঁয়াতেই শট নেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড, তবে গতিহীন আর নাগালের মধ্যে থাকার পরেও শটটা রুখতে পারেননি আরেক ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক অ্যালিসন। ব্যবধানটা ৩-১ করে মাদ্রিদ।
এরপর চাপ বাড়ালেও ব্যবধান আর কমাতে পারেনি কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের শিষ্যরা। ফলে দলটিকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে আগামী ১৪ এপ্রিল ফিরতি লেগের জন্য। নিজেদের মাঠ অ্যানফিল্ডে সেদিন রিয়ালকে ফিরতি লেগে আতিথ্য দেবে লিভারপুল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে প্রথম লেগে হেরেও নকআউট বাধা এড়ানোর নজির দ্বিতীয় সর্বোচ্চবার (১২) গড়ে দেখিয়েছে ইংলিশ দলগুলো। সর্বশেষবার স্প্যানিশ দল বার্সেলোনার বিপক্ষে ৩-০ গোলে হেরেও নকআউট লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছিল এই অল রেডরাই। তবে শেষ কিছু দিনে নিজেদের মাঠে যা ফর্ম, তা মোটেও আশা দেখাচ্ছে না দলটিকে, চলতি বছরে যে নিজেদের মাঠে জয় নেই একটাও!
এদিকে ‘করো, নাহয় মরো’ গোছের একটি সপ্তাহের শুরুটা দারুণই হলো রিয়াল মাদ্রিদের। লা লিগায় লিওনেল মেসির বার্সেলোনার মুখোমুখি হওয়ার ঠিক আগে ক্রুস, মদ্রিচ আর ইস্কোর মাঝমাঠ আর ভিনিসিয়াস অ্যাসেনসিওর এমন আগুনে ফর্মে প্রতিপক্ষকে একটা সতর্কবার্তাও দিয়ে রাখল রিয়াল মাদ্রিদ!