ভারতে কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণে অগ্রাধিকারপ্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী স্বাস্থ্যকর্মী অমিত মেহরা। তবে, অমিত এখন পর্যন্ত টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেননি। টিকা সহজলভ্য হলেও টিকা গ্রহণের বিষয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।
ওদিকে, বিশ্বের আরেক প্রান্ত মস্কোর ম্যাগোমেদ জুরাকোভের চিন্তা-ভাবনাও অমিতের মতোই। টিকাদান কেন্দ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তিনি জানান, তার টিকা গ্রহণের ইচ্ছা নেই। জুরাকোভের সন্দেহ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মহামারির সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে, টিকা না নিলেও কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার জন্য তিনি মাস্ক পরিধানসহ জীবাণুনাশক পণ্য ব্যবহার করছেন।
বর্তমানে, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো টিকাদান ও সরবরাহে শীর্ষে অবস্থান করছে। অন্যদিকে, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো এসব দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে সীমিত আকারে টিকা সংগ্রহে নেমেছে। তবে, এই দুই শ্রেণির বাইরেও তৃতীয় এক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। রাশিয়া, চীন কিংবা ভারতের মতো দেশে টিকা সরবরাহে ঘাটতি নেই। সবগুলো দেশই স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদন করছে। কিন্তু, সরকারিভাবে দেশগুলোর টিকাদান কর্মসূচি বেশ ধীর লয়েই চলছে। টিকাদান বাড়াতে জনগণের মাঝেও রয়েছে উদ্দীপনার অভাব।
দিল্লীর রাজীব গান্ধী সুপার স্পেশ্যালটি হাসপাতালের চিকিৎসক অজিত জৈন বলেন, “টিকাদানের বিষয়ে মানুষের মাঝে কোনো আগ্রহ ও তাড়া দেখা যায়নি। ভারত এখন এমন একটি পর্যায়ে আছে- যখন মাত্র কয়েকটি প্রদেশ ছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাব তেমন দৃশ্যমান নয়। মানুষ নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে করোনার সমাপ্তি ধরে নিয়ে বেশ স্বচ্ছন্দে আছে।”
সময়ের সাথে ভারত, রাশিয়া এবং চীনের এই অভিজ্ঞতা ‘টিপিকাল’ প্রমাণিত হতে পারে। এমনকি ভ্যাকসিন সংকটের সমাধান হলেও, বৃহৎ পরিসরে কোভিড-১৯ টিকাদান বিস্তারে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর। বৃহৎ এবং বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে টিকা পৌঁছানোর মতো চ্যালেঞ্জ ছাড়াও; জনগণের মাঝে টিকা গ্রহণে আগ্রহের অভাব বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
তবে কিছু দেশ এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে। গত দুই সপ্তাহে ভারতে টিকাদান লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকাদানের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ৬০ বছরের বয়সী যে কেউ এখন সহজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারছেন। নতুন এই কর্মসূচির ফলে এই সপ্তাহে দিনে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে দেশটি। এই হারে চলতে থাকলে আগস্টের মধ্যেই ভারত ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের মাধ্যমে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে।
ভারতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত এবং সম্মুখসারির তিন কোটি যোদ্ধাকে প্রথম ধাপে টিকাদানের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত কোভ্যাক্সিন নিয়ে দ্বিধা থাকায় টিকাদান কর্মসূচী ধীর গতিতেই চলতে থাকে। তিনটি ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশের আগেই কোভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু হয়। তবে অন্তর্বর্তী ফলাফল অনুযায়ী এই টিকা ৮১ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর।
অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিভেদি স্কুল অব বায়োসায়েন্সের পরিচালক এবং ভাইরোলজিস্ট ডক্টর শাহিদ জামিল বলেন, “পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশিত না হওয়ায় কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য যারা বিষয়গুলো একটু ভালো বুঝেন তাদের প্রথম ধাপে টিকাদানের কথা থাকলেও, তাদেরকেও সেভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি।”
তবে, ভারত নিজস্ব টিকাদান কর্মীদের সকলকেই কোভিড-১৯ টিকাদানে নিয়োজিত করেনি। অন্যান্য মারাত্মক রোগের কথা বিবেচনা করে- অর্ধেক কর্মীকেই কোভিড টিকাদানের বাইরে রাখা হয়েছে। ডাক্তার জামিল বলেন, “এখানে গর্ভবতী মা এবং শিশুদের জন্য টিকাদান কর্মসূচিও আছে। কোভিড থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য কর্মসূচি যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে।”
সেপ্টেম্বরের পর থেকে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে। বয়সের অনুপাতে দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যক মান ২৮ বছর। আর তাই মৃত্যুর হারও তেমন ভাবে উদ্বেগের সৃষ্টি করেনি। রেকর্ড অনুযায়ী দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার। তবে, প্রতি বছর এর প্রায় তিন গুণ ভারতীয় নাগরিক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
বেইজিং এর জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। তবে তা বয়সের অনুপাতে নয়। দেশটি ভাইরাস বিস্তার রোধে কঠোর, কিন্তু কার্যকরী কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে, চীনে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। দেশটি, জুলাই মাসে সর্বপ্রথম জরুরি ভিত্তিতে টিকাদানের উদ্যোগ নিলেও, এখন পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী টিকা গ্রহণ করেছে।
তবে রাশিয়ার জন্য করোনা সহজ বিষয় ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যানুসারে ৯০ হাজার মৃত্যুর রেকর্ড থাকলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলেই ধারণা করা হয়। তবে, সেখানেও টিকাদান পরিস্থিতি বেশ স্তিমিত। রাশিয়ার সরকার বছরের মাঝামাঝি সময়ের আগেই ৬০ শতাংশ জনগণকে টিকাদানের আওতায় আনার পরিকল্পনা করলেও বাড়েনি টিকাগ্রহণ।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত স্পুটনিক ফাইভ টিকা নিরাপদ এবং কার্যকরি প্রমাণিত হলেও, সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ জনগণই টিকাগ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়েই তাদের মাঝে সংশয়ের শেষ নেই। ৬৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর বিশ্বাস করোনাকে জৈব অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
মহামারি ব্যবস্থাপনায় রাশিয়া সরকারের সমালোচনাকারী একটি সংস্থা- ডক্টর’স এলায়েন্স। সংস্থাটির মুখপাত্র সার্গেই রিবাকোভ জানান, রুশ সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থাই টিকাদানের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। এছাড়া, বাইরের দেশগুলোতে রাশিয়া স্পুটনিক ফাইভের প্রচারণা চালালেও, রুশ নাগরিকদের মধ্যে টিকা সম্পর্কে প্রচার চালানো হয়নি, বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্যান্য দেশেও টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হতে পারে। ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলেও, হার্ড ইম্যুনিটি অর্জনে ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের আওতায় আনতে কয়েক বছর লাগতে পারে বলে জানান সান ফ্রান্সিসকোর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বাবাক জাভিদ।
জাভিদ জানান, দেশগুলো স্বাস্থ্যকর্মী এবং ঝুঁকিপূর্ণদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টার পরিবর্তে সকলকে টিকাদানের আওতায় আনার দিকে মনোযোগ দিতে পারে। “আপনি কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মৃত্যু পুরোপুরি অপসারণ করতে পারবেন না, তবে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর উপর চাপ কমাতে পারবেন,” বলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান