মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রচলিত ধাপ লঙ্ঘন করায় রাশিয়ার তৈরি করোনাভাইরাস টিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতার বিষয়ে দৃঢ় সন্দেহ পোষণ করে। একইসঙ্গে, বিশ্বজুড়ে এটি সরবরাহের উদ্যোগকে একটি স্বৈরাচারী সরকারের প্রভাব বিস্তারের মিথ্যে প্রচারণা বলেও নাকচ করে দেয়।
কিন্তু, পর্দার আড়ালে দেখা যাচ্ছে বিপরীত দৃশ্য,- মস্কোর স্পুটনিক ফাইভের চালান জোগাড় করে নিজেদের ৪৫ কোটি জনসংখ্যাকে টিকার আওতায় আনার স্তিমিত প্রচেষ্টায় নতুন গতি আনতে চায় ইউরোপিয় জোটটি। জোটটির কূটনীতিক এবং আনুষ্ঠানিক সূত্রে এব্যাপারে জানতে পারে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে ইইউ- এর পক্ষ থেকে আলোচনাকারী এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ইইউভুক্ত কিছু দেশের সরকার রাশিয়ার স্পুটনিক ফাইভ টিকা উৎপাদকদের সঙ্গে আলোচনার চিন্তাভাবনা করছে। নিয়ম অনুযায়ী চারটি সদস্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে এমন অনুরোধ আসলে তখন জোট হিসেবে আলোচনার উদ্যোগ নেবে ইইউ।
ইইউ সদস্যদের মধ্যে ইতোমধ্যেই রুশ কোভিড প্রতিষেধকের ডোজ কিনেছে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া। অপর সদস্য ইতালিও নিজ দেশের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক বায়োরিঅ্যাক্টর কাজে লাগিয়ে রুশ প্রতিষেধকটি বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের কথা ভাবছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সদস্য দেশগুলোয় ধীরগতির টিকাদানের কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে ব্রাসেলস। সম্প্রতি নিজ নাগরিকদের মধ্যে টিকাদানে গতি আসায় সাবেক জোট সদস্য দেশ ব্রিটেন ইইউ’তে ভ্যাকসিন সরবরাহের কড়াকড়ি শিথিল করছে। কিন্তু, সঙ্কট বহুমুখী, ইতোমধ্যেই সংক্রমণ হার বাড়ায় আবারও কঠোর লকডাউন চালু করছে ইতালি। ফ্রান্সের প্যারিসে হাসপাতালগুলোয় উপচে পড়ছে রোগীর ভিড়। আবার সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানার শঙ্কায় সতর্কতা জারি করেছে জার্মানি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি শুরু থেকেই টিকার বাড়তি চালান কিনে রাখার দিক থেকে এগিয়েছিল ইইউ। ভ্যাকসিন উৎপাদক ছয়টি পশ্চিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও করে তারা। আরও দুই প্রস্তুতকারকের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইইউ এপর্যন্ত চারটি কোম্পানির টিকা অনুমোদন দিলেও উৎপাদন চক্রে নানা রকম সমস্যা বাধাগ্রস্ত করছে সার্বিক টিকাদান কর্মসূচিকে। এই অবস্থায় ব্রাসেলসের উপর আস্থা হারিয়ে নিজেদের মতো করে সমাধান খুঁজছে কিছু সদস্য রাষ্ট্র।
স্পুটনিক ফাইভ ইইউ এর প্রতিষেধক ঝুলিতে যোগ হলে; তা হবে রাশিয়ার জন্য বিশাল কূটনৈতিক বিজয়। কারণ, এর আগে ক্রিমিয়া দখল এবং পূর্ব ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে রাশিয়ার উপর বিভিন্ন রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ইইউ।
তবে রাশিয়ার ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার পথ সহজ নয়। একারণে ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তৈরি হতে পারে স্পষ্ট বিভাজন। যেসব দেশ মস্কোর স্পষ্ট বিরোধী তারা এই সিদ্ধান্তে নাখোশ হবে, কোনোভাবেই তারা মস্কোর জয় মেনে নেবে না। অন্যদিকে, ভ্যাকসিন সংগ্রহের পক্ষে থাকা রাষ্ট্রগুলো যুক্তি দেবে যে, ইইউ সহযোগিতার মাধ্যমে মস্কোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে।
রয়টার্সকে অপর এক ইইউ কর্মকর্তা ইতালির জৈব-প্রযুক্তি কোম্পানি রেইথেরার একটি কারখানাকে স্পুটনিক ফাইভ উৎপাদনের সম্ভাব্য কেন্দ্র হিসেবে ইঙ্গিত দেন। রেইথেরার ৩০ শতাংশ মালিকানা রাষ্ট্রীয়, কোম্পানিটি স্পুটনিক ফাইভ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ইতালির শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রও এনিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বলেন, “সরকারিভাবে অনুমোদিত সকল টিকা আমরা যেকোনো স্থানে উৎপাদন করতে পারি।”
টিকা উৎপাদকদের সঙ্গে আলোচনা পরিচালনাকারী ইউরোপিয় কমিশনের এক মুখপাত্র জানান, ইইউ যদি ভ্যাকসিনটি অনুমোদনও দেয়, তারপরও এটি সংগ্রহের আলোচনার শুরু করাটা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
তবে যেসব সদস্য দেশ দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে স্পুটনিক ফাইভ টিকা ক্রয়ের আদেশ দিয়েছে, তারা ইইউ এর সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় যোগ দেবে কিনা- তাও নিশ্চিত নয়। এব্যাপারে মন্তব্যের জন্য ক্রয়াদেশ দেওয়া চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি এবং স্লোভাকিয়ার সরকারি মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। কিন্তু, তারা এতে সাড়া দেননি।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো টিকার চালান সংগ্রহের আগে, কয়েক মাস ধরে টিকা আবিষ্কারক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালানো হয়। ইইউ কর্মকর্তারা জানান, তাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় স্পুটনিক ফাইভ আবিষ্কারক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
তবে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের সরকারগুলোর অভ্যন্তরীণ আলোচনায় রুশ ভ্যাকসিন প্রসঙ্গ উঠে আসা তাদের আগের অবস্থানের নাটকীয় পরিবর্তনকে তুলে ধরছে।
ইতোপূর্বে, মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অপর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের কথা উল্লেখ করে স্পুটনিক ফাইভকে রুশ পররাষ্ট্র নীতির মিথ্যে প্রচারণার হাতিয়ার বলেছে ইইউ। শুরু থেকেই এসব সন্দেহ ও অনাস্থা পোষণ করেছে জোটটি।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউরোপিয় কমিশন প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েনও এনিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ইইউ এর অনুপাতে রাশিয়া তার নিজস্ব ভ্যাকসিন অনেক কম সংখ্যক নাগরিককে দিতে পেরেছে। এই অবস্থায় দেশটি কোন যুক্তিতে লাখ লাখ ডোজ রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েছে- তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এমনকি গেল সপ্তাহেও ইইউ নেতাদের সম্মেলন- ইইউ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল স্পুটনিক ফাইভ টিকা প্রমোশনে রুশ প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন।
এসময় তিনি বলেন, “চীন ও রাশিয়ার কারণে আমাদের বিভ্রান্ত হতে পারি না। এ দুটি দেশের শাসকগোষ্ঠী আমাদের তুলনায় অনেক দুর্বল মূল্যবোধে বিশ্বাসী। আর সেকারণেই তারা বিশ্বজুড়ে সমালোচনার শিকার নিজেদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন ঢাকঢোল পিটিয়ে সীমিত সংখ্যক কিছু মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করছে। তাদের মূল্য উদ্দেশ্য; ভ্যাকসিন বাণিজ্য আর কূটনৈতিক প্রভাব অর্জন। ইউরোপ তাদের মতো করে ভ্যাকসিন নিয়ে মিথ্যে প্রচারণা চালাবে না।”
মাইকেলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি মস্কো ও বেইজিং। তবে এর আগে ইইউ এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন ইস্যুর রাজনীতিকরণের অভিযোগ তুলেছিল রাশিয়া।
সূত্র: রয়টার্স