দীর্ঘ দির ধরেই মিয়ানমারের সাথে সখ্যতা চীনের। রোহিঙ্গা গণহত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান, সব ক্ষেত্রেই তাদেরকে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে চীন। তবে অভ্যুত্থানের পরে সামরিক কনভয়ের যে দৃশ্য দেখা যায়, তাতে আরেকটি পার্শ্বদৃশ্য ধরা পড়ে। সেটা হলো দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ মস্কোর গভীর সম্পর্ক।
রাস্তায় টহল দেয়া হালকা সাঁজোয়া যানের বেশিরভাগ রাশিয়ার তৈরি। মস্কো থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানির যে দীর্ঘ তালিকা রয়েছে মিয়ানমারের এসব যান কিছু ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (সিপ্রি) রিপোর্টে দেখা যায়, দেশটি গত এক দশকে রাশিয়া থেকে ৮০৭ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। ১ ফেব্রুয়ারি সকালে যেসব রাশিয়ান যান দেখা গেছে সেগুলো সাম্প্রতিক আমদানি—দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে। কিন্তু এসব যানের কথা দেশটির সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ নেই বলে সিপ্রির সিনিয়র গবেষক সাইমন ওয়েজম্যান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মিয়ানমারে ছিলেন এমন এশিয় কূটনীতিকরা দেশটির তৃতীয় সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতি রাশিয়ার সমর্থনে তেমন অবাক হননি। তারা বলেন, চীনের উপর নির্ভরতা কমাতে মিয়ানমারের সেনা প্রধান ও অভ্যুত্থানের হোতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং গত এক দশক ধরে মস্কোর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করে আসছেন। তাতমাদাও নামে পরিচিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাশিয়ার কৌশল অনুসরণ করে তার প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক বিকল্পগুলো সম্প্রসারণ করছে বলে এক কূটনীতিক জানান। তিনি বলেন, সামরিক সম্পর্কের দিক দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তাতমাদাওয়ের সুসম্পর্ক রয়েছে। আর কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো থেকে তারা উপকৃত হয়।
অভ্যুত্থানের আগে-পরের দিনগুলোতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়। চীনের সঙ্গে মিলে রাশিয়া আন্তর্জাতিক সমালোচনা থেকে মিয়ানমার জান্তাকে রক্ষা করছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা প্রস্তাবও আটকে দিয়েছে। ক্যু’র কয়েক দিন আগে মিয়ানমার সফর করে অস্ত্র চুক্তি চূড়ান্ত করে যান রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল সের্গেই শইগু। এসব অস্ত্রের মধ্যে পানশির-এস১ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপনাস্ত্র, ওরলান-১০ই নজরদারি ড্রোন ও রাডারের মতো সরঞ্জাম রয়েছে।
এসময় গণমাধ্যমকে জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেন, রাশিয়া সবসময় সত্যিকারের বন্ধুর মতো মিয়ানমারের কঠিন সময়ে সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে গত চার বছরে। মিন অং হ্লাইং রাশিয়ায় ছয়বার সফরে গিয়েছেন বলে মিয়ানমারের মিডিয়া জানায়। সর্বশেষ গত জুনে, রাশিয়ার ৭৫তম বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাবাহিনী দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা অং সান সু চি’কে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নিতে দেয়নি। গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে সু চি’র দল জয়ী হয়। সেনাপন্থী দলের পরাজয় নিয়ে মিন অং হ্লাইং প্রকাশ্যে কথা বলেন। তখনই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে সেনাবাহিনী হয়তো সু চি’র দলকে ক্ষমতা নিতে দেবে না।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫০ বছরের নিবর্তনমূলক সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে যে যাত্রা শুরু করার পরপরই অং হ্লাইং তাতমাদাওকে ঢেলে সাজাতে রাশিয়ান সরঞ্জামের দিকে ঝুঁকেন। তিনি সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহদমন বাহিনী থেকে মানসম্মত বাহিনীতে পরিণত করার দিকে মনযোগ দেন। ইয়াঙ্গুনের বিশ্লেষক নায় ইয়ান ও বলেন, অনেক দিন ধরেই তাতমাদাও নেতারা সশস্ত্র বাহিনীকে উন্নত করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০১১ সালের পর এ কাজে ব্যাপক গতি পায়।
মিয়ানমার ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামের ৫০ শতাংশই আমদানি করে চীন থেকে। এগুলোর মধ্যে যুদ্ধজাহাজ, জঙ্গিবিমান, সশস্ত্র ড্রোন, সাঁজোয়া যান ও বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। রাশিয়া থেকে ১৭ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম আমদানি হয় বলে সিপ্রি জানায়। রাশিয়ান সরঞ্জামের মধ্যে জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টার প্রধান। ২০১০-১৯ মেয়াদে মিয়ানমার ২.৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে বলে সিপ্রি জানায়। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে কেনা হয়েছে ৮০৭ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। মিয়ানমারের নতুন অস্ত্রসম্ভারের মধ্যে রয়েছে মিগ-২৯, এসডিইউ-৩০এমকে ও জেএফ-১৭ এবং প্রশিক্ষণ ক্রাফট কে-৮, ইয়াক-১৩০ ও জি১২০টিপি।
মিয়ানমার-রাশিয়া অস্ত্র বাণিজ্যের সূচনা হয় ২০০১ সালে, দুই দেশের মধ্যে সামরিক-কারিগরি সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে। তখন মিয়ানমারের সেনাশাসক ছিলেন সিনিয়র জেনারেল থান শোয়ে। ২০১৬ সালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি হয়। এই চুক্তির পর মিয়ানমারের ছয় হাজারের মতো সেনা অফিসার রাশিয়ায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সাম্প্রতিক এক রাশিয়ান ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে যে অনেক মিয়ানমার অফিসার রাশিয়ান ভাষায় অনর্গণ কথা বলতে পারেন।
রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সখ্যতা একদিনে তৈরি হয়নি। এর ১৯৮০ দশকের শেষ পর্যন্ত চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক জোরদার ছিল। কিন্তু পরে মিয়ানমার-চীন সীমান্তে জাতিগত সংঘাতে চীনের নাক গলানো ও চীনের তৈরি ত্রুটিপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামের কারণে তাতমাদাও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। চীনের মতো রাশিয়া মিয়ানমারের জাতিগত শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি বা মিয়ানমারে বিনিয়োগও করেনি। রাশিয়ার ভূকৌশলগত স্বার্থ কম থাকায় দেশটিকে তাতমাদাওয়ের লোভনীয় অংশীদারে পরিণত করেছে। তবে মিন অং হ্লাইং চীনকে না চটানোর ব্যাপারে বেশ স্মার্ট কৌশল খাটিয়েছেন বলে এক এশিয় কূটনীতিক স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি চীনাদের তেমন বিশ্বাস করেন না। তবে মিয়ানমারের অস্তিত্বের জন্য চীনই একমাত্র হুমকি, রাশিয়া নয়।
সূত্র: এসএএম।